পূর্ণাঙ্গ
ধর্মীয় রিসার্চ সেন্টার না
থাকার ফলে একদিকে যেমন ধর্মীয়
দল / মতগুলোর
সংশোধন-উন্নয়ন
ঘটছে না, অপরদিকে
তেমনি বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত
মুসলমানেরা ঐক্যবদ্ধও হতে
পারছে না। মুসলিম সমাজ হলো
জ্ঞানভিত্তিক সমাজ। এখানে
গোত্র প্রথাও নেই যে বিভিন্ন
গ্রুপ আলাদা আলাদা গোত্র
হিসেবে নিজেদের কর্মকাণ্ড
পরিচালনা করবে। আদর্শ মুসলিম
উম্মাহ গোটা বিশ্বব্যাপী একই
মূলনীতিতে চলবে, এবং
তাদের মধ্যে পরস্পরবিরোধিতা
থাকবে না। এটা নিশ্চিত করতে
হলে ধর্মীয় রিসার্চ সেন্টারের
গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পূর্ণাঙ্গ
ধর্মীয় রিসার্চ সেন্টার থাকলে
সেখানে নিয়মিত জ্ঞান চর্চার
মাধ্যমে প্রতিটি গ্রুপই যেমন
নিজেদের ভুল-ত্রুটির
সংশোধন করতে পারবে,
অপরদিকে
তেমনি সকল গ্রুপের সর্বোচ্চ
জ্ঞানী ব্যক্তিরা রিসার্চ
সেন্টারে একত্রিত হয়ে পরস্পর
জ্ঞান বিনিময়ের মাধ্যমে ঐক্যের
দিকে পৌঁছাতে পারবে। অতঃপর
এই রিসার্চ সেন্টার থেকে যেসকল
দিক-নির্দেশনা
আসবে, মুসলিম
জনগণ সেটা মেনে চলবে। রাসূলের
(সা.)
অনুপস্থিতিতে
আলেম সমাজের কর্মকাণ্ড এভাবেই
পরিচালনা করা প্রয়োজন। কিন্তু
তা না করে যদি প্রতিটি গ্রুপ
তাদের নিজস্ব মতবাদ /
মতামত নিয়েই
সন্তুষ্ট থাকে, পরস্পরের
সাথে জ্ঞান-বিনিময়
না করে, এবং
নিজেদের চিন্তাধারাকে শতভাগ
সঠিক বলে ধরে নিয়ে প্রচার-প্রসার
করতে থাকে, তাহলে
যা ঘটবে তা হলো, সময়ের
সাথে সাথে গ্রুপগুলো আকারেই
কেবল বাড়বে, কিন্তু
তাদের ভুল-ভ্রান্তিগুলো
রয়েই যাবে, এবং
বিভিন্ন গ্রুপের মাঝে
দ্বন্দ্ব-সংঘাতেরও
নিরসন কখনো হবে না।
মুসলিম
মিল্লাত কিভাবে ঐক্যবদ্ধ
হবে, যখন
তাদের নেতারা (আলেম
সমাজ) ঐক্যবদ্ধ
নন? আর
আলেম সমাজের এই ঐক্য হতে হবে
জ্ঞানগত ঐক্য। সেজন্যে একটি
মুসলিম ভুখণ্ডের সকল আলেমকে
এক প্ল্যাটফর্মে আসতে হবে।
একই প্ল্যাটফর্মে এসে পরস্পর
জ্ঞান-বিনিময়
করতে হবে। অতঃপর নিজেদের
ভুলগুলো সংস্কার করতে হবে,
সংশোধন-উন্নয়ন
করতে হবে। আর এটাকেই আমি বলছি
"কমপ্লিট
রিলিজিয়াস রিসার্চ সেন্টার"।
এধরণের রিলিজিয়াস রিসার্চ
সেন্টারই হবে সকল ধর্মীয়
কর্মকাণ্ডের উৎস। ধর্মীয়
নেতৃত্বও এখান থেকেই আসতে
হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে,
আমাদের
মুসলিম সমাজে জ্ঞান অর্জনের
চেয়ে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড করার
উপরই জোর দেয়া হয় বেশি। অথচ
ইলম (knowledge) বিহীন
আমল (practice) কোনোই
গুরুত্ব বহন করে না। আর ইলম
ছাড়া যারা আমল করতে যায়,
স্বাভাবিকভাবেই
তারা ভুল আমল করবে। যদি এমন
হতো যে, প্রতিটা
ইসলামী দল / মতেরই
নেতৃত্ব একটি রিসার্চ সেন্টারে
নিয়মিত একত্রিত হন, তাহলে
আমরা কারো মাঝে ভুল দেখলে সেটা
ঐখানে গিয়ে পেশ করতে পারতাম।
কিন্তু ইসলামের নামে তৈরী
হওয়া বিভিন্ন দল / গ্রুপগুলোর
নেতারা নিজেদের অনুসারীদের
কাছ থেকেই এজাতীয় কথা গ্রহণ
করে না, আর
অন্য গ্রুপের কাছ থেকে নিজের
ভুল শোনার তো প্রশ্নই আসে না।
অতএব, সংশোধন
ও ঐক্য আসবে কিভাবে?
প্রতিটা
গ্রুপই নিজেদের কলেবর বৃদ্ধির
প্রতিযোগীতায় ব্যস্ত,
অথচ ঐক্যের
দিকে কারোরই নজর নেই। মুসলিম
সমাজের এই জ্ঞানগত ঐক্যের
জন্য জ্ঞানকেন্দ্র,
অর্থাৎ
পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় রিসার্চ
সেন্টার অপরিহার্য।
এখন,
ইসলাম নিয়ে
জ্ঞান অর্জনের পূর্বশর্ত যে
জ্ঞানতত্ত্বের (Epistemology)
পড়াশুনা,
তা আলেমসমাজকে
কিভাবে বুঝানো সম্ভব?
"আলেমসমাজ"
বলেইতো আসলে
কিছু নেই। কোনো ইস্যুতে
"আলেমসমাজের
কাছে গিয়েছিলাম" কথাটাই
বলা সম্ভব নয়, বরং
বলা যেতে পারে যে, ওমুক
হুজুর আর ঐ হুজুরের শত্রুর
কাছে গিয়েছিলাম ইস্যুটা নিয়ে।
আমাদের বাস্তবতাটা এতই করুণ!
মুসলিম সমাজে
যদি কোনো পাপ কাজের প্রচলন
দেখি, তবে
সমাধানের জন্য কার কাছে যাবো?
আলেমসমাজ
বলে তো কোনো ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্মই
নেই! অতএব,
যারা ইসলাম
নিয়ে স্বাধীন জ্ঞানচর্চা
করছে ও বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত
করছে, তারা
অসহায়ের মত আশেপাশের দুয়েকজন
মানুষকে বিচ্ছিন্নভাবে
সতর্ক-সংশোধনের
চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে,
গোড়ায় গিয়ে
যে সমাধান করবে, সেই
গোড়ায় (আলেমসমাজের
কাছে) যেতে
পারছে না। আর বিভিন্ন নেতৃত্বের
কাছে গেলেও, রিসার্চারের
ন্যায় মনোভাব না থাকায় তারা
নিজেদের ভুল স্বীকার করতে
কিংবা অন্য কোনো চিন্তা সম্পর্কে
স্টাডি করতেও রাজী হন না।
ইসলামের
নামে সমাজে নানান ইসলামবিরোধী
কর্মকাণ্ড চলছে। এগুলো নেতাবিহীন
নয়; অবশ্যই
ইসলামের নামে এসব কর্মকাণ্ড
বিভিন্ন নেতৃত্বের মাধ্যমে
পরিচালিত হচ্ছে। ইসলামবিরোধী
এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হলে
ও সঠিক ইসলামের প্রচার করতে
হলে সেইসব ধর্মীয় নেতৃত্বের
সংশোধন প্রয়োজন। সেই নেতাদের
সংশোধনের জন্য, সকল
ধর্মীয় নেতৃত্বকে একই প্ল্যাটফর্মে
আনার জন্য, ঐক্য
সৃষ্টির জন্য ও সংস্কার-উন্নয়নের
জন্য কমপ্লিট রিলিজিয়াস
রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা
করা প্রয়োজন, যেখানে
সকল ধর্মীয় নেতৃত্বের মতবিনিময়,
জ্ঞানবিনিময়
ও সাহায্য-সহযোগীতা,
সংস্কার-উন্নয়ন
ইত্যাদি ঘটবে। অতঃপর বিভিন্ন
দেশের রিসার্চ সেন্টারগুলোর
মাঝে বড় পরিসরে জ্ঞান-বিনিময়
হলে বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য
প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে,
এবং এইরূপ
জ্ঞানগত ঐক্যের মাধ্যমেই
গোটা দুনিয়ার মুসলিম উম্মাহর
একই পতাকাতলে আসা সম্ভব হবে।
রিলিজিয়াস
রিসার্চ সেন্টার না থাকার
ফলে দেখা যায় যে, কোনো
ব্যক্তি আজীবন ইসলামের সংকীর্ণ
একটি গণ্ডিতেই জ্ঞানচর্চা
চালিয়ে গিয়েছে। অথচ হয়তো সে
যে ধারায় পড়াশুনা করেছে,
তার ভিত্তিই
ভুল ছিলো! কিংবা
সে সঠিক পদ্ধতিে জ্ঞান অর্জন
করে নাই। শুধু ইসলামের বিভিন্ন
ধারা নয়, অন্যান্য
ধর্ম, তুলনামূলক
ধর্মতত্ত্ব, দর্শন,
যুক্তিশাস্ত্র
ইত্যাদি সকল প্রাসঙ্গিক স্টাডি
টপিকের সম্পর্কে মানুষ জানতে
পারবে রিসার্চ সেন্টারের
কাছে এসেই। শুধু একটি ধারায়
জ্ঞানচর্চার যে সমস্যা,
তা রিসার্চ
সেন্টার ব্যতিরেকে দূর করা
সম্ভব নয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন
গ্রুপ নিজেদের ধারার বইপত্রই
পড়ে থাকে, এমনকি
বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যেও
অন্য ধারার বইপত্র পড়ে না।
ফলস্বরূপ সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে
থাকার কারণে ভুল-ভ্রান্তির
সংশোধন ঘটে না, অন্যান্য
ধারা থেকে সঠিক জিনিসটাও গ্রহণ
করা হয়ে ওঠে না। সকল ধরণের
জ্ঞানগত বাধা (barrier)
অতিক্রমকারী
পূর্ণাঙ্গ ধর্মতত্ত্বকেন্দ্র
প্রতিষ্ঠা করা তাই খুবই জরুরি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন