সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইসলাম - কুরবানির ঈদ প্রসঙ্গে

বনের পশুও নয়, মনের পশুও নয়, কুরবানি করতে হবে "মায়া"।

মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আ.), যিনি আমাদেরকে "মুসলিম" নামকরণ করেছেন, তিনি আল্লাহর ইচ্ছায় নিজ সন্তান ইসমাইল (আ.)কে কুরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন -- সেই ঘটনার স্মরণের দিন আজ। সেইসাথে তাঁর শিক্ষাকে আত্মস্থ করারও সময় এটা।

ইবরাহীম (আ.) কোনো গুনাহগার ব্যক্তি ছিলেন না, এবং ছিলেন না মুশরিক (কুরআন, ২:১৩৫, ১৬:১২০-১২৩)। তিনি আল্লাহর প্রেরিত একজন নবী ছিলেন, এবং তাঁর ভিতরে "পশুত্ব" বলে কোনো ব্যাপার ছিলো না। বরং নবুওয়্যাতের দাবী অনুসারে তিনি ছিলেন সর্বাবস্থায় নিষ্পাপ নিষ্কলুষ এবং উত্তম আখলাকের অধিকারী ব্যক্তি।
এমন একজন নিষ্পাপ ব্যক্তি, যাঁর ভিতরে পাশবিক গুণাবলী তো ছিলোই না, বরং যিনি ছিলেন আল্লাহর নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পনকারী উত্তম গুণের অধিকারী ব্যক্তি, তিনি যখন "কুরবানি" করেছিলেন (কুরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন), তখন তা মানুষের ভিতরের কোনো পশুত্বের কুরবানি ছিলো না, বরং তা ছিলো খোদায়ী এক গুণের উপর আরেক গুণের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করা: মায়াকে বিসর্জন দেয়া।

দয়া, মায়া, ভালোবাসা -- ইত্যাদি খোদায়ী গুণ। একজন নবী (ইবরাহীম (আ.)) যখন তাঁর সন্তানকে (ইসমাইল (আ.)কে) ভালোবাসেন, এবং সেই সন্তানও যখন সৎকর্মশীল ব্যক্তি ও আল্লাহর নবী -- তখন সেই ভালোবাসা ও মায়া নিশ্চিতই নিষ্পাপ মায়া, নিষ্পাপ ভালোবাসা। এরূপ মায়া ও ভালোবাসা উত্তম গুণ। এবং এই গুণের চর্চা নিশ্চিতভাবেই খোদায়ী গুণের চর্চা। এই ভালোবাসা আল্লাহ কর্তৃক তাঁর সৎ বান্দাহদের দুনিয়াবী পুরষ্কার। সৎকর্মশীল মুমিনদের অন্তরের পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা আল্লাহর দেয়া পুরষ্কার (কুরআন, ১৯:৯৬)।

অতএব, এমন উত্তম জিনিস, যার উপভোগে কোনো বাধা নেই দুনিয়াতে এবং আখিরাতেও, সেই নিষ্পাপ ভালোবাসাকেও আল্লাহর ইচ্ছার কাছে বিসর্জন দেয়াটা হলো আল্লাহর বন্দেগীর সর্বোচ্চ পরীক্ষা। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছানুযায়ী পথ চলার কারণে আল্লাহ যে প্রতিদান দিয়েছেন, তা যদি আল্লাহ কেড়েও নেন, তবুও আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পনকারী হয়ে থাকা, মুসলিম হয়ে থাকা -- এটা কুরবানির অন্যতম আধ্যাত্মিক তাৎপর্য।

ইবরাহীম (আ.) এর এই কুরবানি তাই কোনো খারাপ গুণ বিসর্জনের শিক্ষা নয়। বরং এটা অতি উচ্চ পর্যায়ের তাক্বওয়ার শিক্ষা, যা দ্বীনদার পরহেযগার ব্যক্তিদেরকে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের শিক্ষা দেয়, এবং আল্লাহর দেয়া নিষ্পাপ, পবিত্র উপহার যদি আল্লাহ কেড়েও নেন, তাতেও ধৈর্য্য ধারণ করার শিক্ষা দেয়।

সমাজে যেভাবে কুরবানির ঈদ পালনের প্রচলন রয়েছে, তাতে ইবরাহীম (আ.) এর কুরবানির এই আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রতিফলন ঘটা প্রয়োজন। পশু কুরবানি করে গরিব-দুঃস্থদেরকে একদিন খাওয়ানো নয়, নিজের কিছু টাকার মায়া ত্যাগ করা নয়, বরং এই দিনে এমন তাক্বওয়া অর্জনের শিক্ষা নিতে হবে, যেই তাক্বওয়া যেকোনো খোদায়ী পরীক্ষার মোকাবিলায় মানুষকে দৃঢ়তা দান করে, আল্লাহর নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পনকারী (মুসলিম) করে তোলে। সেই তাক্বওয়ার কথাই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন পবিত্র কুরআনে :
"এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া।..." (সূরা হাজ্জ্ব, ২২:৩৭)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

টাকার ইতিহাস, মানি মেকানিজম ও ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মহা জুলুম

ভূমিকা: জালিমের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম  (মহররম: ইনফো সিরিজ এর শেষ পোস্ট ছিল এটা। মূল সিরিজটি পড়ে আসুন ) জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাস হলো মহররম মাস। জালিমের মুখোশ উন্মোচনের মাস মহররম। জুলুমের কূটকৌশল উন্মোচনের মাস মহররম। আধুনিক সেকুলার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় লেজিসলেশান (সংসদ), আর্মড ফোর্সেস (আর্মি) ও জুডিশিয়ারি (আদালত) হলো এক মহা জুলুমের ছদ্মবেশী তিন যন্ত্র, যারা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে জুলুম টিকিয়ে রাখার জন্য। তারচেয়েও বড় জালিম হলো big corporations: বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, যারা তাবৎ দুনিয়াকে দাস বানিয়ে রেখেছে। আর এই দাসত্বের শৃঙ্খলে তারা আমাদেরকে আবদ্ধ করেছে ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মাধ্যমে: টাকা আমাদের শ্রমকে ধারণ করে, অথচ সেই টাকার মূল্য আপ-ডাউন করায় অন্যরা -- ব্যাংক ব্যবসায়ীরা! টাকা আমাদের শ্রমকে সঞ্চয় করার মাধ্যম, অথচ সেই টাকা আমরা প্রিন্ট করি না, প্রিন্ট করে (ব্যাংকের আড়ালে) কিছু ব্যবসায়ী! সেই টাকার মান কমে যাওয়া (বা বেড়ে যাওয়া) আমরা নির্ধারণ করি না -- নির্ধারণ করে ব্যাঙ্ক (ব্যবসায়ীরা)! ইমাম হুসাইনের (আ.) প্রতিবাদী চেতনাকে ধারণ করব, শোকাহত হ

ধর্মব্যবসা: মুসলমানদের হাতে ইসলাম ধ্বংসের অতীত-বর্তমান (১)

ভূমিকা যদিও পলিটিকাল-রিলিজিয়াস ইস্যুতে নিশ্ছিদ্র আর্গুমেন্ট উপস্থাপন করে আলোচনা করার অভ্যাস আমার, কিন্তু এখানে বিস্তারিত ইতিহাস তুলে ধরে আর্গুমেন্ট করার প্রথমতঃ ইচ্ছা নেই, দ্বিতীয়তঃ সময় ও সুযোগ নেই। আমি যা সত্য বলে জানি, তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি। যারা আমার উপর আস্থা রাখেন তাদের জন্য এই লেখাটি সোর্স অব ইনফরমেশান, উন্মুক্ত হৃদয়ের মানুষদের জন্য সত্য অনুসন্ধানের নতুন কিছু টপিক, আর প্রেজুডিসড ধর্মান্ধ রোগগ্রস্ত অন্তরের জন্য রোগ বৃদ্ধির উছিলা। শেষ পর্যন্ত আর্গুমেন্ট ও ডায়লগের দুয়ার উন্মুক্ত রাখার পক্ষপাতী আমি, কিন্তু সেই আর্গুমেন্ট অবশ্যই সত্য উন্মোচনের নিয়তে হওয়া উচিত, নিজের দীর্ঘদিনের লালিত বিশ্বাস ও ধ্যান ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করবার উদ্দেশ্যে নয়। মক্কা-মদীনা: মুহাম্মদ (সা.) থেকে আলে-সৌদ (৬২৯-১৯২৪) এদেশের অধিকাংশ মানুষ মক্কা-মদীনার ইতিহাস কেবল এতটুকু জানেন যে, মুহাম্মদ (সা.) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন। কিন্তু প্রায় চৌদ্দশ’ বছর আগে মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র থেকে আজকের রাজতান্ত্রিক সৌদি আরবের ইতিহাস কম মানুষই জানেন। প

পিস টিভি, জাকির নায়েক ও এজিদ প্রসঙ্গ

সম্প্রতি গুলশান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। আমি তখন দিল্লীতে ছিলাম। দেশে ফিরে শুনি পিস টিভি ব্যান করা হয়েছে বাংলাদেশে, এবং তার আগে ইন্ডিয়াতে। আমার বাসায় টিভি নেই, এবং আমি জাকির নায়েকের লেকচার শুনিও না। কিংবা পিস টিভিতে যারা লেকচার দেন, বাংলা কিংবা ইংলিশ -- কোনোটাই শুনি না; প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া আমার ইসলামের বুঝ জাকির নায়েকসহ পিস টিভি ও তার বক্তাদেরকে ইন জেনারেল আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। Peace TV বন্ধ হওয়ায় এদেশে বিকৃত ইসলাম প্রসারের গতি কমলো -- এটাই আমার মনে হয়েছে। একইসাথে আমি এটাও মনে করি যে, যেই অভিযোগ পিস টিভিকে ব্যান করা হয়েছে, তা নিছক অজুহাত। জাকির নায়েক কখনো জঙ্গীবাদকে উস্কে দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। কিংবা পিস টিভির লেকচার শুনে শুনে ISIS জঙ্গীরা সন্ত্রাসী হয়েছে -- এটা নিতান্তই হাস্যকর কথা। ISIS এর ধর্মতাত্ত্বিক বেইজ সম্পর্কে মোটেও ধারণা নেই, এমন লোকের পক্ষেই কেবল ISIS এর জন্য জাকির নায়েককে দোষ দেয়া সম্ভব। একইসাথে আমি এ বিষয়েও সচেতন যে, পিস টিভি বন্ধ করা হয়েছে আমাদের সরকারের রেগুলার “ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের অংশ