সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

টাকার ইতিহাস, মানি মেকানিজম ও ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মহা জুলুম

ভূমিকা: জালিমের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম

জালিমের মুখোশ উন্মোচনের মাস মহররম।
জুলুমের কূটকৌশল উন্মোচনের মাস মহররম।
আধুনিক সেকুলার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় লেজিসলেশান (সংসদ), আর্মড ফোর্সেস (আর্মি) ও জুডিশিয়ারি (আদালত) হলো এক মহা জুলুমের ছদ্মবেশী তিন যন্ত্র, যারা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে জুলুম টিকিয়ে রাখার জন্য।
তারচেয়েও বড় জালিম হলো big corporations: বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, যারা তাবৎ দুনিয়াকে দাস বানিয়ে রেখেছে।
আর এই দাসত্বের শৃঙ্খলে তারা আমাদেরকে আবদ্ধ করেছে ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মাধ্যমে:
টাকা আমাদের শ্রমকে ধারণ করে, অথচ সেই টাকার মূল্য আপ-ডাউন করায় অন্যরা -- ব্যাংক ব্যবসায়ীরা!
টাকা আমাদের শ্রমকে সঞ্চয় করার মাধ্যম,
অথচ সেই টাকা আমরা প্রিন্ট করি না, প্রিন্ট করে (ব্যাংকের আড়ালে) কিছু ব্যবসায়ী! সেই টাকার মান কমে যাওয়া (বা বেড়ে যাওয়া) আমরা নির্ধারণ করি না -- নির্ধারণ করে ব্যাঙ্ক (ব্যবসায়ীরা)!
ইমাম হুসাইনের (আ.) প্রতিবাদী চেতনাকে ধারণ করব, শোকাহত হব কারবালার স্মরণে, অভিশাপ দেব জালিম এজিদকে ও এজিদের অপকৌশলের মুখোশ উন্মোচন করব, অথচ --
অথচ যামানার এজিদদের চিনব না, আধুনিক যুগের জুলুমের মুখোশ উন্মোচন করব না, তাদের জুলুমের অ্যাপারেটাসগুলিকে চিনব না --
তবে জালিমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনা কেবল হৃদয়ের ভিতরেই র'য়ে যাবে, কার্যকর রূপ ধারণ করতে পারবে না। এবং যামানার ইমামের (আ.) আগমণের ক্ষেত্রও প্রস্তুত হবে না।
তাই মহররমে কেবল আবেগাপ্লুত ও শোকার্ত হওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং আধুনিক যুগের সকল নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার মুখোশ উন্মোচন করতে হবে, এবং সেজন্যে দীর্ঘ বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনার প্রস্তুতি নিতে হবে।
আর বর্তমান বিশ্বের অর্থব্যবস্থা হলো একালের সকল জুলুমের গোড়া। এটার সম্যক ধারণা অর্জন তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
"Who controls the money, controls the world."
আধুনিক অর্থব্যবস্থা, কাগজের নোট, নোটের মূল্য নির্ধারণ, গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড, কাগজের নোটের মূল্য কেন বছর বছর কমে, এর সুবিধা কারা পায়, মুদ্রাস্ফীতি কী, অর্থনৈতিক মন্দা কী, ব্যাঙ্কের behind the scene কাজ কী, ইত্যাদি বিষয়ে সাধারণের বোঝার উপযোগী করে কিছু আর্টিকেল লিখলাম।

নূরে আলম মাসুদ
মহররম, ১৪৩৮ হিজরি
অক্টোবর, ২০১৭
পর্ব-১: এক পয়সা বানাতে দেড় পয়সা খরচ


কখনো কি ভেবে দেখেছেন, পয়সা কেন সোনালী রঙের হয়? কিংবা রুপালী?
কেন কালো রঙের হয় না? কিংবা, লাল-নীল-সবুজ হয় না?
অধিকাংশ পয়সা তৈরী করা হয় বিভিন্ন সস্তা ধাতু দিয়ে। কিন্তু যেন চকচক করে, সেজন্যে উপরে তামার প্রলেপ দেয়া হয়।

আচ্ছা, এবার আরেকটা কথা বলি।
আমাদের দেশে এক সময় ১ পয়সা, ৫ পয়সা, ২৫, ৫০ পয়সা ইত্যাদি ছিল। ওগুলো এখন নাই। এমনকি এখন ১ টাকার কয়েন পর্যন্ত পাওয়া যায় না। কাগজের নোট তো উধাও।
কিন্তু এই ইউরোপ-আমেরিকার লোকেরা খুব যত্ন করে এইসব ১ সেন্ট, ৫ সেন্ট ইত্যাদি চালু রেখেছে। আপনি আজকে বসুন্ধরা সিটিতে যান, একটা মোবাইল কিনে আনেন। ফোনের দাম: ৪৯,৯৯৯ টাকা। আপনি ৫০ টা ১ হাজার টাকার নোট বের করে দিলেন। কী ঘটবে? ১ টাকা ফেরত পাবেন বলে মনে হয়?
আপনিও চাইবেন না, ওরাও দিবে না। কারণ - ভাঙতি নেই! আর আমরা অনেক ধনী দেশ কিনা, এইসব ১-২ টাকা আমাদের কাছে ব্যাপার না। ৫০ পয়সা, ২৫ পয়সা - এগুলোতো আমাদের কাছে মূল্যহীন হয়ে গিয়েছে আরো আগেই!! (হায় বোকা জাতি!)
আর যদি ভুল করে ১ টাকা ফেরত চেয়ে বসেন তো কথাই নেই তাহলে। আপনার দিকে এমনভাবে তাকাবে যে, আপনি যেন অস্পৃশ্য নিচু জাতের কেউ!!
ইউরোপ-আমেরিকায় অবশ্য আপনি ৫০ হাজার কেন, ১ লক্ষ টাকার জিনিস কিনলেও যদি ১ টাকা ফেরত দিতে হয়, দোকানী ঠিকঠিক দিয়ে দেবে।
ওদের সরকার ১ সেন্ট এর পয়সাগুলো পর্যন্ত টিকিয়ে রেখেছে।

এবার মাথা নষ্ট করা তথ্য দেই (২০১৬ সালের হিসাব)।
এই মার্কিন ১ সেন্ট = বাংলাদেশী ১ টাকা প্রায়) তৈরী করতে ওদের সরকারের খরচ হয় ১.৫ সেন্ট!
আরো শুনবেন?
৫ সেন্ট তৈরী করতে মার্কিন সরকারের ব্যয় হয় ৬.৩ সেন্ট!
অর্থাৎ, ১ টাকার কয়েন বানাতে দেড় টাকা খরচ, আর
৫ টাকার কয়েন বানাতে সাড়ে ছয় টাকা খরচ!
তারমানে নেট লস! এত লস দিয়ে মহান মার্কিন সরকার জনগণের সেবায় কাজ করে যাচ্ছে, এবং বাজারের যেন প্রয়োজনীয় কয়েন থাকে, সেটা নিশ্চিত করছে। আহা! মহান আমেরিকান সরকার!
(বাংলাদেশ সরকারের হিসাবটা কেউ দিতে পারবেন? বা জানেন?)

পর্ব-২: বাজারে যতবেশি খুচরা পয়সা থাকবে ততই শ্রমের মূ্ল্য পাবো, নতুবা শ্রম leak হয়ে যাবে
আমরা দেখি যে, সময়ের সাথে সাথে কম মানের পয়সাগুলি অচল হয়ে যায়। যেমন, একসময় ৫ পয়সা অচল হলো, তারপর ১০ পয়সা অচল হলো, তারপর ২৫ পয়সা, তারপর ৫০ পয়সা...। এভাবে করে দেশে এখন বলা চলে ১ টাকাও প্রায় অচল।
একদিকে সর্বনিম্ন মানের মুদ্রা অচল হতে থাকে (৫, ১০, ২৫, ৫০...), অপরদিকে সর্বোচ্চ মানের নোট ছাড়া হতে থাকে (৫০০, ১০০০)। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে একবার এর বিপরীত ঘটনা ঘটেছিলো।
'৭৩ সালে সর্বনিম্ন মানের মুদ্রা ছিল ৫ পয়সা।
'৭৪ সালে সর্বনিম্ন মুদ্রা হিসেবে ১ পয়সা চালু হলো।
(আচ্ছা, তাহলে '৭৫ সালে আধা পয়সা চালু হলে কেমন হতো?)
এখন, কোনটাকে ন্যাচারাল ধরব? সময়ের সাথে সাথে ৫, ১০, ২৫ পয়সা অচল হয়ে যাওয়া, নাকি সময়ের সাথে সাথে ১, আধা ইত্যাদি পয়সা চালু হওয়া?
বিষয়টা নিয়ে একটু চিন্তা করেন।

এবার ভিন্ন একটা কথা বলি। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একবার বলেছিলেন, সর্বনিম্ন ৫ টাকার নোট/ কয়েন থাকবে। ১-২ টাকার নোট, কয়েন - সব বাতিল করে দেবেন। এই নিয়ে বিশাল হৈচৈ পড়ে গেছিলো। ব্যবসায়ীরা প্রতিবাদ করেছিলো। কেন করেছিলো, জানেন?
সেটা বুঝতে পারলেই বোঝা যাবে ১ পয়সা, ৫ পয়সার গুরুত্ব কী।
ধরেন, অর্থমন্ত্রীর আদেশক্রমে আজকে থেকে সব ১-২ টাকার নোট আর কয়েন বাতিল। সর্বনিম্ন চলবে ৫ টাকা।
তাহলে, বাসে আগে যেপথে ২ টাকা দিতাম, সেখানে এখন বাধ্য হয়ে ৫ টাকা দিতে হচ্ছে। আমার ৩ টাকা লস! টাকা লস না, আমার শ্রম জলে গেল! কারণ ঐ ৩ টাকা তো আমি কষ্ট করে মাটি কেটে কামাই করেছিলাম! এখন সেটা বাস মালিকের কাছে চলে গেল! আমি ৩ টাকা পরিমাণ শ্রমের কোনো বিনিময় পেলাম না!
পানির পাইপে লিক (leak) হলে যেমন পানি পড়ে গিয়ে নষ্ট হয়, সেভাবে করে আমার শ্রম leak হয়ে গেল ৫ টাকার নোটের মাধ্যমে!
আবার ধরেন, রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দুইটা আমলকি ফল খেতে মন চাইলো। এক লোক ফুটপাথে আমলকি বিক্রি করছে। কিন্তু এখনতো ২ টাকা অচল, তাহলে মিনিমাম ৫ টাকার আমলকি কিনতে হবে। ৫ টাকায় আমাকে অনেকগুলো আমলকি দিলো। আমিতো এতগুলো খাবো না। দুইটা খেলাম। বাকিগুলো নষ্ট হলো।
খেলাম ১ টাকা পরিমাণ আমলকি, কিন্তু বাধ্য হয়ে দিলাম ৫ টাকা। আমার ৪ টাকা লস - সেটা চলে গেছে আমলকিঅলার পকেটে! ৫ টাকার নোটের মাধ্যমে বিনিময় করার কারণে আমার ৪ টাকা পরিমাণ শ্রম leak হয়ে গেল।
টাকা কামাই করার সময় কিন্তু ঠিকই আমাকে পুরোপুরি শ্রম দিয়েই ৫ টাকা উপার্জন করতে হয়েছে, সেটা মাটি কেটেই হোক আর যেভাবেই হোক।

এইরকম যদি পদে পদে ঘটতে শুরু করে, দোকানি, আমলকিঅলা, বাসঅলা, ইত্যাদি রাস্তাঘাটে সবার সাথে সবার গোলমাল বেঁধে যাবে। মারামারি, ঝগড়াঝাঁটি...। কেউ বলবে, "ব্যাটা এট্টুক রাস্তা ২ টাকাও হয় না, আর এখন ৫ টাকা দেব? ভাড়াই দেব না যাহ।" ইত্যাদি আরো কত গণ-অসন্তোষ সৃষ্টি হবে!
আর গণ-অসন্তোষ বৃদ্ধি পেলে একসময় সরকার উল্টে যাবে। ইতিহাসে সবসময় এটা ঘটেছে। কারণ, মানুষের শ্রম leak হয়ে যাচ্ছে। পানির পাইপের ছিদ্র দিয়ে যেভাবে পানি পড়ে নষ্ট হয়, সেভাবে কাগজের নোটের মধ্যদিয়ে মানুষের শ্রম leak হয়ে যাচ্ছে।
অলরেডি আমাদের দেশে এমনটা ঘটতেছে। আপনি যদি ন্যূনতম মধ্যবিত্ত হন, তাহলে দেখবেন যে, বাসে ৫ টাকার নোট দিলে ২ টাকার ভাড়ার জায়গায় ৩ টাকা রেখে দিচ্ছে। দোকানে জোর করে চকলেট দিয়ে দিচ্ছে - ১ টাকার ভাঙতি নাই! ৯৯ টাকার জিনিসে ১ টাকা ফেরত দিচ্ছে না। কারণ মার্কেটে ১ টাকার কয়েন/নোট নাই।
১ টাকা অচল হওয়াতেই এই অবস্থা, তাহলে চিন্তা করেন সর্বনিম্ন ৫ টাকা হলে কী অবস্থা হবে! কিংবা, অর্থমন্ত্রী যদি আগামীকাল ঘোষণা দিয়ে বলেন, সর্বনিম্ন টাকা হবে ১০ টাকা? কিংবা ১০০ টাকা?
আমাদের কী পরিমাণ শ্রম leak হবে, চিন্তা করতে পারেন? বাসে উঠলেই ১০ টাকা, চকলেট কিনতে গেলেই ১০ টাকা! কিংবা ১০০ হলেতো আরো খারাপ অবস্থা হবে। এখন মানুষ টের পাচ্ছে না, কিন্তু তখন ঠিকই টের পাবে যে, তাদের অনেক শ্রম leak হয়ে যাচ্ছে। টাকা কামাই করার সময় তারা দিনরাত শ্রম দিয়েই টাকা কামাই করছে, কিন্তু টাকার বিনিময়ে যখন সে কিছু কিনতে যাচ্ছে, তখন তাকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দিতে হচ্ছে -- কারণ --
কারণ ভাংতি নাই!
কারণ ১ টাকার কয়েন অচল!
কারণ ৫০ পয়সা উধাও‍!
কারণ ১ পয়সা বাতিল‍!
গত পর্বে বলেছিলাম যে, মহান (!) মার্কিন সরকার তাদের দেশে ১ পয়সা এখনো চালু রেখেছে, যদিও এই ১ পয়সার উৎপাদন খরচ দেড় পয়সা! ইউরোপেও একই কাহিনী। ১ ইউরো সেন্ট চালু আছে সব জায়গায়। দামী ফোন কিনতে গেলে সেই দোকানেও আপনি ওদের ১ পয়সা পাবেন। ওরা নিশ্চিন্তে আপনাকে ১ পয়সা ফেরত দেবে। বা নির্দ্বিধায় আপনার থেকে চেয়ে নেবে।
কেন জানেন? কারণ ওদের সরকার জানে, মানুষের শ্রম leak হয়ে গেলে গণ-অসন্তোষ বাড়ে, আর গণ-অসন্তোষ বাড়লে সরকার উল্টে যায় -- ইউরোপে বহুবার এমনটা ঘটেছে। তাই মানুষের শ্রম যেন leak না হয়, একারণে লস দিয়ে হলেও তারা ১ পয়সা চালু রেখেছে মার্কেটে। মানুষের শ্রমের মূল্য দিচ্ছে।

পর্ব-৩: দ্রব্য বিনিময়ের মার্কেটে টাকার আগমন, টাকার উপরে আস্থা সৃষ্টি, game of trust ও দু্ইটি সূত্র
ধরেন, একজন কৃষক। তার নাম চালঅলা। অর্থাৎ, সে চাল উৎপাদন করে।
আরেকজন কৃষক। তার নাম ডালঅলা। সে ডাল উৎপান করে।
আরেকজন টাকমাথা বৃদ্ধ লোক। তার নাম মালঅলা। তার কাছে মাল (টাকা) আছে।
পৃথিবীতে আর কোনো মানুষ নাই।
চালঅলার গোলায় অনেক চাল (ধান)। কিন্তু তার দরকার ডাল, তাহলে সে ডাল-ভাত খেতে পারবে।
একইভাবে ডালঅলার দরকার চাল।
একদিন বটতলায় বসে চালঅলা আর ডালঅলা চুক্তি করলো।
চালঅলা: "আমার প্রতিমাসে দরকার ১০ কেজি ডাল।"
ডালঅলা: "আমার প্রতিমাসে দরকার ৩০ কেজি চাল।"
৩০ কেজি চাল = ১০ কেজি ডাল। এরকম চুক্তি হলো। আর দূরে বসে মালঅলা দেখে আর গজগজ করে: "ব্যাটা, আমি হলাম মালঅলা, আর তোরা আমাকে বাদ দিয়ে লেনদেন করিস? দাঁড়া, সিস্টেম করতেসি।"
সে যাহোক। তো, এই বটতলা হলো মার্কেট। আর কৃষকেরা হলো producer - পণ্য উৎপাদনকারী। আবার তারা consumer-ও, অর্থাৎ ভোক্তা। কিন্তু এই মার্কেটে টাকার কোনো অস্তিত্ব নেই। মানুষ সরাসরি দ্রব্য (প্রোডাক্ট) বিনিময় করে। আর প্রোডাক্ট-ই তো আসল জিনিস! টাকা তো আর মানুষ খায় না, মাথায়ও দেয় না। মানুষ খায় চাল, ডাল ইত্যাদি।
প্রশ্ন হলো, তাহলে টাকার কী দরকার? কাগজের টাকা, কিংবা তারও আগে স্বর্ণমুদ্রা - এগুলো চালু হলো কেন? মানুষের কাছে বিভিন্ন প্রোডাক্টের চেয়েও টাকা বেশি মূল্যবান হয়ে গেল কেন?

বটতলায় ফিরে আসি। তো একদিন সেই মালঅলা লোক গিয়ে চালঅলাকে বলল, "দেখ, প্রতিমাসে ত্রিশ কেজি চাল ঘাড়ে করে বাজারে টেনে আনতে তোমার কষ্ট হয়। তারচেয়ে এক কাজ করো। এই নাও দশটা ১ টাকার নোট। মোট ১০ টাকা। এই দশ টাকা ডালঅলাকে দিয়ে তুমি দশকেজি ডাল নিয়ে এসো।"
চালঅলা: "বললেই হলো? এই কাগজ দিয়ে ডালঅলা কী করবে? আর তুমি ভেবেছো এই কাগজ দিলে ও আমাকে এমনি এমনি দশকেজি ডাল দিয়ে দেবে? কাগজের কোনো মূল্য আছে?"
-- "আগে ডালঅলাকে বলেই দেখ না!"
আর ওদিকে ডালঅলার কাছে গিয়ে বলে, "তোমারও তো ত্রিশ কেজি চাল একবারে ঘাড়ে নিয়ে যাওয়া কষ্ট। তারচেয়ে তুমি চালঅলার কাছ থেকে ১০ টাকা নেবে। আর কিছুদিন পরপর ওকে ১ টা করে নোট ফেরত দেবে, আর ৩ কেজি করে চাল নেবে। এভাবে দশদিনে তোমার ত্রিশ কেজি চাল নেয়া হয়ে যাবে! Easy!"
ডালঅলা ভাবে, আমারতো সুবিধাই হয়, কিন্তু চালঅলা কি মানবে?
তারপর তারা আবার বটতলায় একত্রিত হয়। চালঅলা খালি হাতে এসেছে, শুধু দশটা ১ টাকার নোট। ডালঅলা এনেছে ডাল।
চালঅলা: "দেখ, আমি ভাবছিলাম কি, তুমি যদি এই নোটগুলো নাও..."
-- "আরে, আমিও তো সেটাই ভেবেছি। আমার জন্যও সহজ হয়।"
ব্যস! চাল আর ডালের মাঝখানে ঢুকে গেল টাকা!
৩০ কেজি চাল = ১০ টাকা = ১০ কেজি ডাল।
ডালঅলা বাসায় গিয়ে ভাবে, "এই প্রতিটা ১ টাকার নোট মানেই ৩ কেজি করে চাল!"
তারপর কিছুদিন পরপর ১ টা করে নোট চালঅলাকে দেয়, আর তিন কেজি করে চাল নিয়ে আসে। এভাবে করে মাসশেষে টাকাগুলো ধীরে ধীরে আবার চালঅলার কাছে গিয়ে জমে।
তখন চালঅলা ভাবে: "এই প্রতিটা ১ টাকার নোট মানেই ১ কেজি করে ডাল!"
ব্যস! টাকার উপরে মানুষের আস্থা তৈরী হয়ে গেল! এখন সেটাকে কাগজের টাকাই বলেন, কি স্বর্ণমুদ্রাই বলেন, কি রৌপ্যমুদ্রাই বলেন।
টাকা হয়ে গেল middle man। বিনিময়ের মাধ্যম। টাকার উপর সবার খুব ভরসা। খুব আস্থা।

এই "আস্থা" শব্দটা খুউব ভালো করে লক্ষ্য করবেন।
বিরক্ত হতে পারেন যে, এত সহজ একটা জিনিস কেন এতক্ষণ ধরে বুঝালাম। এটাতো সবাই-ই বোঝে!
হ্যাঁ, এটুকু সবাই-ই বোঝে, কিন্তু মানি মেকানিজম বোঝে না! ব্যাংকিং সিস্টেমের জোচ্চুরি বোঝে না! কারণ, এই "আস্থার" জায়গাটাকে মিসইউজ/ অ্যাবিউজ করেই পুঁজিবাদীরা আরো ধনী হয়েছে, আর অশিক্ষিত মূর্খ মানুষেরা আরো দরিদ্র হয়েছে। আর আমরা যারা এই "আস্থার খেলা - game of trust" বুঝি না, তারাও সেসব মূর্খ মানুষদেরই অন্তর্ভুক্ত!

এই পর্বে খুব সহজ করে লিখলাম। কিন্তু এই পর্ব থেকে যেন দুইটা জিনিস মাথায় থাকে, সেটা হলো:
৩০ কেজি চাল = ১০ টাকা = ১০ কেজি ডাল।
আর দ্বিতীয় যেটা মনে রাখা দরকার, সেটা হলো: এপাশে চালঅলা, ওপাশে ডালঅলা, মাঝখানে টাকা -- কিন্তু এই টাকার উপরে দুইজনেরই খুব আস্থা।
অর্থাৎ,
• টাকা = আস্থার বস্তু।
• আর ৩০ কেজি চাল = ১০ টাকা = ১০ কেজি ডাল।
এই দুইটা জিনিস মনে রাখতে হবে। কেননা, ইকোনমিক্সের বড় বড় শব্দ (যেগুলো আসলে সবই বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো আরকি), যেমন ইনফ্লেশান তথা মুদ্রাস্ফীতি, ডিফ্লেশান, ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ, ইন্টারেস্ট, ব্লা ব্লা ব্লা... --
ইকোনমিক্সের এই সমস্ত গালভরা শব্দ সব বুঝে ফেলবেন, যদি উপরের দুইটা সূত্র ঠিকমত বোঝেন। তখন আর বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো যাবে না।
যখনই দেখবেন উপরের দুইটা সূত্র ভঙ্গ হচ্ছে, বিকৃত করা হচ্ছে, তখনই বুঝবেন জোচ্চুরি হচ্ছে। আপনার শ্রম leak হয়ে যাচ্ছে, চুরি হয়ে যাচ্ছে, আপনি টের পাচ্ছেন না।

বাস্তবের মার্কেট ঐ বটতলার মত এত সিম্পল না। বাস্তবের মার্কেটে অসংখ্য ক্রেতা-বিক্রেতা থাকে। আর বিভিন্নরকম নোট থাকে। থাকে সরকার। থাকে ব্যাংক। যারা লোন দেয়। ইন্টারেস্ট নেয়। ট্যাক্স কাটে। আরো কত কী ঘটে!
বটতলার মার্কেটটা বুঝতে পারলেন, কিন্তু বর্তমান যুগের মার্কেট আর মানি মেকানিজম তাহলে বোঝেন না কেন?
সবই বোঝা যাবে, যদি আমরা উপরের দুইটা সূত্র ভালোমত মগজে ঢুকাতে পারি।
পরের পর্বে মুদ্রাস্ফীতি (inflation) আলোচনা করব। সেটা খুব সহজেই বুঝতে পারবেন, যদি সূত্র দুইটা মাথায় রাখেন। আবারো বলছি:
• টাকা = আস্থার বস্তু।
• আর ৩০ কেজি চাল = ১০ টাকা = ১০ কেজি ডাল।

পর্ব-৪: কাগজের নোটভিত্তিক অর্থব্যবস্থার ফাঁকফোঁকর অনুসন্ধান: from programming to hacking a system
একজন প্রোগ্রামার শুধু কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরী করে। আর একজন হ্যাকার/ কম্পিউটার ভাইরাস মেকার সেটার ফাঁক-ফোঁকর-দুর্বলতা খোঁজে। প্রোগ্রামারের লক্ষ্য থাকে কিভাবে কম্পিউটারকে দিয়ে একটা কাজ করানো যায়। আর হ্যাকারের লক্ষ্য থাকে, কিভাবে ঐ কাজটাকে ভণ্ডুল করা যায়।
তো, ইতিহাসে যারা টাকা/ স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করেছিলো, তারা প্রোগ্রামারের মত করে কিছু সমস্যা সমাধান করতে চেষ্টা করেছিলো। তারই একটা সমস্যা গত পোস্টে দেখিয়েছি।
আর ইতিহাসের ব্যাংকাররা হ্যাকারের মত করে টাকাভিত্তিক অর্থব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মানুষকে শোষণ করার চেষ্টা করেছে, এবং মহা সমারোহে আজ পর্যন্ত তা করে যাচ্ছে।
কিন্তু গোটা ব্যাপারটা আসলে কিভাবে হচ্ছে? সেটা বুঝতে হলে আমাদেরকে ঐ বেসিক মার্কেটের উদাহরণে ফিরে যেতে হবে: বটতলা, চালঅলা, ডালঅলা, মালঅলা।
সংক্ষেপে কাহিনী হলো, চালঅলা আর ডালঅলা বটতলায় গিয়ে সরাসরি দ্রব্য বিনিময় করতো, কিন্তু কেজি কেজি চালডাল পরিবহনে অসুবিধা বলে মালঅলার পরামর্শক্রমে তারা কাগজের নোট ব্যবহার শুরু করলো। হিসাবটা ছিল এরকম:
• টাকা = আস্থার বস্তু।
• আর ৩০ কেজি চাল = ১০ টাকা = ১০ কেজি ডাল।
আর এতে যে কত সুবিধা হয়, সেটা আমরা গত পোস্টেই দেখেছি: দশটা ১ টাকার নোট (মোট দশ টাকা) দিয়ে দশ কেজি ডাল নিয়ে আসে চালঅলা। পরে ডালঅলা এক একদিন ১ টা করে নোট চালঅলাকে দেয়, আর ৩ কেজি করে চাল আনে, এভাবে করে দশবারে মোট ত্রিশ কেজি আনা হয়ে যায়: একবারে ঘাড়ে করে ত্রিশ কেজি টানতে হয় না।

এতো গেলো প্রোগ্রামারের মত চিন্তা। "প্রবলেম: দ্রব্য পরিবহন সমস্যা, সমাধান: কাগজের নোটের মাধ্যমে অল্প অল্প করে বিনিময়।"
এবার হ্যাকারের মত চিন্তা করেন। গত পোস্টে এই সহজ জিনিসটা এত বিস্তারিত বুঝিয়েছি একারণেই যে, এবার আমরা হ্যাকারের মত করে উপরের সিস্টেমটাকে exploit করব। অর্থাৎ, বিকৃত করব; ফাঁক-ফোঁকর বের করে চাল-ডালঅলাকে ঝামেলায় ফেলব।
নিচে আমি পয়েন্ট করে করে "টাকার মাধ্যমে বিনিময়" সিস্টেমের কতগুলো exploit দেখাচ্ছি। অর্থাৎ, এই "টাকা" নিয়ে দুইজনকে কিভাবে ঝামেলায় ফেলায় যায়, সেটা। পয়েন্টগুলো পড়ার আগে চোখ বন্ধ করে ৫ মিনিট চিন্তা করে দেখুনতো, আপনি নিজে কয়টা exploit বের করতে পারেন?
Exploit- ১
 মাসের শুরুতে দশটা ১ টাকার নোট ডালঅলাকে দিয়েছিলো চালঅলা। বিনিময়ে সে দশকেজি ডাল নিয়ে এসেছিলো বাড়িতে। কথা ছিল, ডালঅলা ঐ ১ টা করে নোট ফেরত দেবে, আর ৩ কেজি করে চাল নিয়ে যাবে।
বাসায় এসে চালঅলার মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চাপলো। চালও তার কাছে, দশকেজি ডালও তার কাছে। বেচারা ডালঅলার কাছে আছে শুধুই দশটা কাগজ।
পরদিন ডালঅলা ১ টাকার একটা নোট নিয়ে আসলো। কথামতো চালঅলার তিনকেজি চাল দেবার কথা। (এভাবে করে দশবারে মোট ত্রিশ কেজি চাল দেবার কথা।) সে আর তা দেয় না। চুক্তির কথা অস্বীকার করে। "এসব কী কাগজ নিয়ে আসছো? তোমার ডালের বিনিময়ে তো আমি ত্রিশকেজি চাল ঐদিনই না দিয়ে দিলাম?"
ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি: ডালঅলা।
exploit: আস্থা।
analysis: আগে যখন বটতলায় গিয়ে দুইজনে সরাসরি চাল-ডাল বিনিময় করতো, তখন এ ধরণের সিচুয়েশান হবার কোনো চান্স ছিলো না।
Exploit- ২
ডালঅলার পকেটে দশটা ১ টাকার নোট। কাল সে চালঅলার কাছে যাবে, ১ টাকা দিয়ে তিন কেজি চাল আনবে।
চালঅলা একটা পকেটমার ভাড়া করলো ১ কেজি চালের বিনিময়ে। পকেটমার গিয়ে ডালঅলার দশটা নোটের একটা গায়েব করে দিলো। ডালঅলা কিছুই টের পেলো না।
তারপর সে যায়, ১টা নোট দেয়, চালঅলাও তাকে হাসিমুখে তিনকেজি চাল দেয়। কয়দিন পর আবার যায়, আবার একটা নোট দেয়, চালঅলা আবার তাকে চাল দেয়। এভাবে করে একদিন ডালঅলা টের পায়: নোট তো একটা কম!
চালঅলাকে গিয়ে বলে: "নোট একটা খুঁজে পাচ্ছি না, মনে হয় হারিয়ে গেছে। যাহোক, তুমি আমাকে বাকী তিন কেজি চাল দিয়ে দাও।"
(চালঅলা দুইরকম জবাব দিতে পারে:)
জবাব-১: "না, এটাতো চুক্তি ছিল না। এখন আমি তিনকেজি দিয়ে দেই, আর কালকে যদি তুমি ঐ ১ টাকার নোট খুঁজে পাও, আর এসে আবার চাল দাবী করো?"
জবাব-২: "কই, নাতো? তুমিতো গতদিন যে আসলে, ঐদিনই তুমি আমাকে দশম নোটটা দিয়েছ, এইযে দেখ সেই নোট। আর আমিও তোমাকে তিনকেজি চাল দিয়েছি, এমাসের ত্রিশকেজি তোমাকে দেয়া হয়ে গেছে।"
ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি: ডালঅলা।
exploit: টাকার সহজ-বহনযোগ্যতা।
analysis: ডালঅলার পকেট থেকে ১ টাকা চুরি যাওয়া মানে আসলে তার (ভবিষ্যতের) তিনকেজি চাল চুরি যাওয়া। কিংবা ১০ টাকা চুরি যাওয়া মানে তার ভবিষ্যতের ত্রিশ কেজি চাল চুরি যাওয়া। দ্রব্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে এই রিস্ক ছিলো না। কারণ ত্রিশকেজি চাল একবারে চুরি করা যায় না, কিন্তু দশটা নোট সহজেই চুরি করা যায়।

পাঠক! আবারো বিরক্ত হতে পারেন যে, এত সহজ জিনিস কেন এত বিস্তারিতভাবে বুঝাচ্ছি। কারণ, উপরের দুইটা পয়েন্ট-ই টাকার রিস্ক, এবং এটা আপনি জেনেশুনেই টাকা ব্যবহার করেন, এবং টাকা সাবধানে রাখেন যেন চুরি না যায়।
কিন্তু এই একই কাগজের টাকার অন্যান্য রিস্ক, যেমন, ইনফ্লেশান - সেটা বোঝেন না কেন তাহলে?
কারণ কখনো হ্যাকারের মত করে সিস্টেম exploit করেন নাই। টাকা চুরি যাবার পর জেনেছেন যে, টাকার রিস্ক চুরি যাওয়া। কিন্তু inflation এর মধ্যেই জন্ম-বড় হবার কারণে আর টের পান নাই যে, টাকার সবচে বড় রিস্ক হলো inflation.
এবার ৩ নাম্বার exploit দেখেন।
Exploit- ৩
দূরথেকে সেই টাকমাথা মালঅলা ওদের ঝগড়া দেখে আর মিটিমিটি হাসে। এবার সে খেলা শুরু করলো। ১ টাকার একটা নোট নিয়ে গিয়ে ডালঅলাকে দিলো। বললো, "এবার তাহলে তোমার হলো মোট ১১ টাকা। আর চুক্তি মোতাবেক প্রতিটা নোটের বিপরীতে তিনকেজি করে চাল দিতে বাধ্য চালঅলা। যাও, এবার গিয়ে চাল ক্লেইম করো।"
ডালঅলাও কথামতো দশম বারের পরে আবারো একদিন গিয়ে হাজির হলো। তার হাতে ১ টাকার নোট। চালঅলা নিজের পকেটে দেখে সেখানেতো অলরেডি দশটা নোট আছে! সেতো ডালঅলাকে মোট ত্রিশকেজি দিয়েই দিয়েছে! আবার একটা নোট নিয়ে এসে সে তিনকেজি চাল দাবী করছে!
কিন্তু ডালঅলা নাছোড়বান্দা। সে উল্টা চালঅলাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করলো: "তুমি একটা নোট বানিয়ে নিজের পকেটে রেখেছ যেন আমাকে তিনকেজি চাল কম দিয়ে পারো।" শেষে চালঅলা বাধ্য হলো তিনকেজি চাল দিতে!
exploit: বাজারে মোট নোটের সংখ্যার উপর ক্রেতা-বিক্রেতাদের কন্ট্রোল নেই।
(এই জায়গাতেই inflation ব্যাপারটা ঘটে, তবে পরের পর্বে সেটা ব্যাখ্যা করব বিস্তারিতভাবে। বিটকয়েন/ ক্রিপটোকারেন্সি এই প্রবলেমটাকেই সলভ করার চেষ্টা করছে।)
নোটের সংখ্যার উপর কন্ট্রোল নেই, কিন্তু নোটের উপর আস্থা আছে!
ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি: চালঅলা।
analysis: যার হাতে টাকা ছাপানোর মেশিন, সে ফাওয়ের উপর দিয়ে ধনী হয়ে যায়!
(বর্তমান যুগে হলো সরকার ও ব্যাঙ্ক।)
Exploit- ৪
কাগজের নোট হাতবদল করতে করতে একদিন ক্ষয় হয়ে গেল/ ছিঁড়ে গেল/ নষ্ট হয়ে গেল। কিংবা পানিতে পড়ে/ আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে গেল।
তখন কৃষক গেল সেই মালঅলার কাছে: “একটা নোট একদম নষ্ট হয়ে গেছে, নতুন একটা নোট বানিয়ে দাও।”
টাকমাথা মালঅলা (ব্যাংক): “হুমম... তা বানিয়ে দেয়া যায়, তবে হালকা একটু চার্জ দিতে হবে আরকি। আমাকে দুইকেজি চাল/ ডাল দিয়ে যাও, বানিয়ে দিচ্ছি।”
ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি: চালঅলা, ডালঅলা
লাভবান: টাকাঅলা (ব্যাংক)
exploit: সময়ের সাথে সাথে কাগজের নোট নষ্ট হয়ে যায়। নোট মুদ্রণে খরচ হয়।
analysis: কাগজের নোটটা ছিল জাস্ট বিনিময়ের মাধ্যম। কিন্তু এখন এই নোটকে বাঁচিয়ে রাখতে/ চালু রাখতে আরো খরচ করতে হচ্ছে, চালডাল দিতে হচ্ছে মালঅলাকে, অর্থাৎ লস হচ্ছে। অথচ বটতলায় সরাসরি দ্রব্যবিনিময়ের ক্ষেত্রে এই এক্সট্রা খরচ লাগতো না!

প্রিয় পাঠক! আরো কিছু exploit কি আপনারা চিন্তা করতে পারেন? তৈরী করতে পারেন?

প্রোগ্রামার হওয়া সহজ, হ্যাকার হওয়া কঠিন!
উপরের ৩ নং এক্সপ্লয়েট, অর্থাৎ মার্কেটে অতিরিক্ত টাকার অনুপ্রবেশ-ই হলো মুদ্রাস্ফীতি বা inflation. কিন্তু সেটা বর্তমান জগতে ঠিক কিভাবে কাজ করে, সেই মেকানিজম ক্লিয়ারলি বুঝতে হলে আগে আরো কিছু জিনিস বুঝতে হবে। সেগুলি নেক্সট পোস্টে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।


পর্ব-৫: বাজারে টাকার পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকলে বছর বছর টাকার মান বৃদ্ধি পাবে
চালঅলা একদিন স্বপ্নে দেখে, কী সুন্দর বউ! পরেরদিন অর্ডার দিয়ে বেহেশত থেকে একটা বউ বানিয়ে আনলো। তার দেখাদেখি ডালঅলাও বিয়ে করলো।
বেচারা দুই কৃষক এতদিন চাল-ডাল বিনিময় করে ডালভাত আর খিচুড়ি খেয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছিলো। কিন্তু এখন তাদের বউয়েরা নানান খাবার রান্না করতে চায়। একজন এক খাবার রান্না করে ভাবীকে দেয় তো আরেকজন আরেক খাবার রান্না করে আপাকে দেয়। এই আরকি!

তো, এতো এক মহা সমস্যা! কৃষকেরা মাছ-মুরগি-গরু, আলু-পটল-শাক, এইসব কোত্থেকে পাবে? এইবার আমাদের বটতলার মার্কেট বড় হতে শুরু করলো। এবং জটিল (complex) হয়ে গেল।
চালঅলা চালের বিনিময়ে সবকিছু পেতে চায়: মাছ, মুরগি, ডিম, শাক, লবণ, ইত্যাদি।
ডালঅলাও একইভাবে ডালের বিনিময়ে সবকিছু পেতে চায়। কিন্তু তার বউ আবার ভেজিটেরিয়ান। তাই সে শুধু আলু-পটল-শাক আনতে বলে দিয়েছে। একারণে ডালঅলা মুরগিঅলার কাছে ডাল বেচবে না (অর্থাৎ, ডাল-মুরগি বিনিময় করবে না)। কারণ সে মুরগি দিয়ে কী করবে? মুরগিতো তার বউ খায় না।
এদিকে মুরগিঅলার বউয়ের খুব শখ তেঁতুল দিয়ে ডাল রাঁধবে! কিন্তু ডালঅলা ডাল বেচবে না। এই নিয়ে গোলমাল, চেঁচামেচি।
বিশাল জটিলতা! দ্রব্য-বিনিময় পদ্ধতির এটা হলো সবচে বড় সমস্যা। অর্থাৎ, “আমি যা দিতে চাই, ও তা নিতে চায় না।” অর্থনীতির ভাষায় বলে: double coincidence of wants না ঘটা, অর্থাৎ, দুইজন দ্রব্য-বিনিময়কারীর চাহিদা না মেলা।

আমাদের বটতলার মার্কেট আগে অনেক সহজ ছিল। চালঅলা চায় ডাল, আর ডালঅলা চায় চাল। তাই তারা বদলাবদলি করত। কিন্তু এখন ব্যাপারটা অনেক জটিল হয়ে গেল। আর এইখানেই হলো টাকার ম্যাজিক। হঠাৎ আবির্ভুত হলো সেই মালঅলা। বললো, "সমাধান করে দিচ্ছি। সবাই এদিকে আসো।"
চালঅলার হাতে সেই দশটা ১ টাকার নোট। তাকে পাশে বসিয়ে মালঅলা একটা কাগজে "নতুন মূল্য তালিকা" লিখে বটগাছের সাথে টানিয়ে দিল। সেখানে লেখা:
১ টাকা = ৬ কেজি চাল
১ টাকা = ২ কেজি ডাল
১ টাকা = ১ টা মুরগি
১ টাকা = ২টা মাছ
১ টাকা = ১০ কেজি আলু
ইত্যাদি...
এবার চালঅলাকে বলে, "নাও, এবার বাজার করো।" চালঅলার হাতে ১০টা এক টাকার নোট। সে প্রথম বাজার করা শুরু করলো।

(পাঠক, হিসাবনিকাশের জন্য রেডি হন!)
চালঅলার হিসাব
৫টা নোট দিয়ে দশকেজি ডাল কিনে নিলো চালঅলা। তার হাতে আরো ৫টা নোট (মোট ৫ টাকা) রয়ে গেল।
তা দিয়ে সে দুইটা মাছ, একটা মুরগি, দশকেজি আলু ইত্যাদি কিনলো (মোট ৩টাকা)।
হাতে রইলো ২ টাকা।
বাকী ৮ টাকা এখন মার্কেটে বিভিন্ন মানুষের হাতে চলে গেল, অর্থাৎ - in circulation বা চালু আছে।
এখন কার হাতে কত আছে?
চালঅলা - ২ টাকা
ডালঅলা - ৫ টাকা
মুরগিঅলা - ১ টাকা
মাছঅলা - ১ টাকা
আলুঅলা - ১ টাকা
____________
মোট = ১০ টাকা
ডালঅলার হিসাব
এবার ডালঅলার হিসাব। দেখা যাক, সে তার ভেজিটেরিয়ান বউয়ের জন্য বাজার করতে পারে কিনা।
ডালঅলার হাতে ছিল ৫ টাকা, ১ টাকা দিয়ে দশকেজি আলু কিনলো, আর ১ টাকার পটল, আর ১ টাকার শাক, বাকী ২ টাকা দিয়ে ১২ কেজি চাল।
এখন কার হাতে কত আছে?
চালঅলা - ৪ টাকা
ডালঅলা - ০ টাকা
মুরগিঅলা - ১ টাকা
মাছঅলা - ১ টাকা
আলুঅলা - ২ টাকা
পটলঅলা - ১ টাকা
শাকঅলা - ১ টাকা
___________
মোট = ১০ টাকা।
শেষ হিসাব
আর মুরগিঅলার বউ তেঁতুল দিয়ে ডাল খেতে চেয়েছিলো। সে এবার ১ টাকা দিয়ে দুইকেজি ডাল কিনলো।
এখন কার হাতে কত আছে?
সেই একই! মোট ১০ টাকা। কেবল টাকা হাতবদল হচ্ছে।
কিন্তু প্রত্যেকেরই বাজার করা হয়ে গেছে। অর্থাৎ, যে যা চায়, সে তা কিনে নিয়েছে। আর দ্রব্য বিনিময় প্রথার সমস্যাও দূর হলো (ডালঅলা বউয়ের চাপে পড়ে মুরগি নিতে চায় না, অথচ মুরগিঅলা বউয়ের জন্য ডাল নিতে চায় -- সেই সমস্যা)।
এই কাজটা কিভাবে সম্ভব হলো?
সকল দ্রব্যের মান টাকায় হিসাব করার কারণে সম্ভব হলো। ঐযে, মালঅলা যে "নতুন মূল্য তালিকা" টানিয়ে দিয়েছিল, মনে আছে? সেই তালিকা অনুযায়ী --
(৬ কেজি চাল = ২ কেজি ডাল = ১ টা মুরগি = ২টা মাছ = ১০ কেজি আলু) = ১ টাকা।
১০ দিয়ে গুণ করলে:
(৬০ কেজি চাল = ২০ কেজি ডাল = ১০ টা মুরগি = ২০ টা মাছ = ১০০ কেজি আলু) = ১০ টাকা।
আর একদম প্রথমে, যখন শুধু দুই কৃষক ছিল, তখন কী ছিল?
(৩০ কেজি চাল = ১০ কেজি ডাল) = ১০ টাকা।
টাকার মান বৃদ্ধি
প্রিয় পাঠক! আবারো যদি বিরক্ত হন, তবে কিছু করার নাই। এত সহজ অঙ্ক এতক্ষণ ধরে কেন বুঝালাম?
কারণ, উপরের ক্যালকুলেশানে আমরা বাজারে মোট টাকার পরিমাণ নির্দিষ্ট রেখেই ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি করে ফেলেছি।
ফলে কী হয়েছে জানেন? টাকার মান বেড়েছে।
আগে ১ টাকায় কয় কেজি চাল পাওয়া যেত? ৩ কেজি।
আর এখন? ৬ কেজি।
তারমানে দ্রব্যমূল্য কমেছে। বা টাকার মান বেড়েছে।
যদি মার্কেটে আরো অনেক ক্রেতা-বিক্রেতা আসে? তখন দেখবেন ১ টাকায় ৬০ কেজি চাল পাওয়া যাবে! তার মানে কী?
তার মানে হলো, যদি আমরা বাজারে মোট নোটের পরিমাণ নির্দিষ্ট রাখি, তাহলে টাকার মান বাড়বে।
নিচের সূত্রটা মুখস্থ করে ফেলেন।
"যদি -- বাজারে টাকার পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকে
এবং যদি তখন -- বাজারে ক্রেতা, বিক্রেতা ও পণ্যের সংখ্যা ও পরিমাণ বৃদ্ধি পায়,
তাহলে -- টাকার মান বাড়বে।"

কিন্তু আমাদের বর্তমান যুগে আমরা সেটা দেখি না কেন? বরং আমরা উল্টোচিত্র দেখি। আমরা দেখি যে, দিনদিন টাকার মান কমে! কেন এমনটা হয়?
কারণ টাকমাথা মালঅলা মিটিমিটি হাসছে।
কারণ এর পরের পোস্টেই সে একটা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করবে, এবং সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে, তারপর...
বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতা ফিক্সড থাকবে, কিন্তু টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে সে।
পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, কিন্তু কই, অর্থমন্ত্রী তো এসে আমাদের হাতে টাকা দিয়ে যায় না? তাহলে মার্কেটে অতিরিক্ত টাকা প্রবেশ করে কিভাবে?
বাজারে অতিরিক্ত টাকা ঢুকানোর এই ব্যাপারটাকেই বলে ইনফ্লেশান বা মুদ্রাস্ফীতি। কিন্তু সেটা ঠিক কোন কৌশলে ঘটানো হয়, সেটা পরের পর্বে দেখব।

পর্ব-৬: Time Value of Money: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সূত্র উল্টাভাবে শিখানো হয়

বাজারে মোট টাকার পরিমাণ নির্দিষ্ট রেখে ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি করলে টাকার মান বৃদ্ধি পায় (বা দ্রব্যমূল্য কমে)। সেটা আমরা গত পর্বে দেখেছিলাম।

অর্থাৎ, এ বছর মার্কেটে ক্রেতা বিক্রেতা ধরেন একশো জন।
এখন ১ টাকায় ৬ কেজি চাল পাওয়া যায়।
সামনের বছর মার্কেটে ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা বেড়ে হলো দুইশো জন।
তখন ১ টাকায় (suppose) ১০ কেজি চাল পাওয়া যাচ্ছে।

কিন্তু সমস্যা হলো, ১ টাকার চেয়ে কম কোনো টাকা না থাকার কারণে আমি দশ কেজির কম কিনতে পারছি না। যদি আমি ৫ কেজি চাল কিনতে চাই?
তখনই আধা টাকা বা ৫০ পয়সার উদ্ভব।
যদি আমি এক কেজি চাল কিনতে চাই? সেক্ষেত্রে ১০ পয়সার কয়েন থাকলে সুবিধা।

এবং এটা টাকার অন্যতম বড় গুণ যে -- তাকে ভাংতি করা যায়, ছোট ছোট মানে বিভক্ত করা যায়।

ঠিক এভাবেই বাংলাদেশে ১ টাকার ভাংতিগুলো (১০ পয়সা, ৫০ পয়সা ইত্যাদি) চালু হয়েছিলো। একটু দুইলাইন ইতিহাস দেখেন:

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ১, ৫, ১০ ও ১০০ টাকার নোট চালু করা হয়।
পরের বছর ১ টাকার ভাংতি হিসেবে চালু করা হয় ৫, ১০, ২৫ ও ৫০ পয়সা।
তার পরের বছর আরো ভাংতি চালু করা হয়: ১ পয়সা।
তার পরের বছর আমাদের উচিত ছিল ১ পয়সার ভাংতি হিসেবে আধা পয়সা চালু করা।

কিন্তু আফসোস! তা না করে বিশ্বের অন্যান্য দেশের দেখাদেখি আমরাও উল্টাপথে হাঁটা শুরু করলাম।
আমাদের উচিত ছিল '৭৫ সালে আধা পয়সা চালু করা। কিন্তু তা না করে আমরা উল্টা ১ পয়সাকে অচল করে দিলাম, তারপর একসময় ৫, ১০, ২৫ ও ৫০ পয়সাকেও অচল করে দিলাম। ইদানিং ১ টাকাকেও অচল করে দিয়েছি প্রায়। অথচ যত ভাংতি পয়সা অচল হবে, তত আমাদের শ্রম লিক হয়ে যাবে, তত মানুষের অশান্তি বাড়বে, গণ-অসন্তোষ সৃষ্টি হবে। (এটা নিয়ে পর্ব-২ এ আলোচনা করেছিলাম।)

বিপরীতক্রমে যত বেশি ভাংতি পয়সা চালু হবে, তত বেশি আমরা শ্রমের মূল্য পাবো, আমাদের শ্রম leak হবে না। ভাংতি না থাকার কারণে ২ টাকার ভাড়া ৩ টাকা দিতে হবে না। আমাদের জনগণের লস কম হবে। লাভ হবে বেশি।

বিস্ময়কর ব্যাপার, তাই না? আমরা এমন এক জাতি, যারা খেলা নিয়ে আনন্দ মিছিল করি, কিন্তু ভাংতি পয়সা অচল হয়ে গেলে বিক্ষোভ মিছিল করি না!
অথচ যদিও ভাংতি পয়সা অচল হওয়া মানে আমার শ্রম নষ্ট হওয়া, আমার শ্রম leak হয়ে যাওয়া, আমার শ্রম ধনী ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাওয়া!

এর কারণ কি জানেন? এর কারণ হলো, এটা স্লো পয়জনিং। গোটা জাতির শ্রম leak হয়ে যাচ্ছে। leak হয়ে কোথায় যাচ্ছে? কার পকেটে যাচ্ছে? এমনকি সেটাও আমরা জানিও না। ৭% শিক্ষাকর আরোপ করলে আমরা রাস্তা অচল করে দেই, অথচ সেই আমরাই -- ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া শিক্ষিত ছেলেমেয়েরাই -- প্রতিদিন যে আমাদের টাকা মাইর যাচ্ছে নানাভাবে, সেটা আমরা টেরও পাই না -- বিক্ষোভ করাতো দূরের কথা! যখন অর্থমন্ত্রী বলেন, সর্বনিম্ন টাকা হবে ৫ টাকা -- তখন আমরা ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা রাস্তা অচল করে দেই না!
অথচ এই সচেতনতাটা ইউনিভার্সিটি থেকেই আসা উচিত ছিল!

যারা ইউনিভার্সিটিতে BBA পড়ে, তারাও আসলে এই ব্যাপারগুলো জানে না। মেজরিটিই জানে না। আমি ইউরোপের ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিক্স কোর্স করেছি, সেখানের প্রফেসরও এগুলো সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়েছে: "টাইম ভ্যালু অব মানি"-কে সূত্র হিসেবে মুখস্থ করিয়েছে শুধু।

Time Value of Money নামে একটা কনসেপ্ট বইপত্রগুলোতে পড়ায়। কিভাবে পড়ায়, জানেন? এইভাবে:
"আমরা দেখি যে, ছোটবেলায় যে আইসক্রিম ৫ টাকা দিয়ে কিনতাম, এখন সেটা আর ৫ টাকায় পাওয়া যায় না। এখন সেটা কিনতে ১০ টাকা লাগে। অর্থাৎ, সময়ের সাথে সাথে টাকার মান কমে। এই ব্যাপারটাকে time value of money বলে।"
(ভবিষ্যত টাকার লাভ-ক্ষতি হিসাবের ক্ষেত্রে এই time value of money-কে অ্যাডজাস্ট করা হয় ক্যালকুলেশানে।)

কেন? কেন সময়ের সাথে সাথে টাকার মান কমবে? এইযে বইয়ে লিখছে: "আমরা দেখি যে" -- আমরা কেন এরকম দেখি? এটা কি আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া কোনো অলঙ্ঘনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম? দুইটা হাইড্রোজেন আর একটা অক্সিজেন মিলে পানি হয় -- সেরকম অলঙ্ঘনীয় নিয়ম?
না! এই "আমরা দেখি যে"-র মার্কেট তো সূক্ষবুদ্ধির পুঁজিবাদী শয়তানদের তৈরী!
আমরাতো চাইলেই সেই বটতলার মার্কেটের উদহারণের মত করে মার্কেট পরিচালনা করতে পারি। যেখানে সময়ের সাথে সাথে টাকার মান বাড়বে। আগে যে আইসক্রিম ৫ টাকায় কিনতাম, সেটা এখন ২ টাকায় কিনব! দশ বছর পর ১ টাকায় কিনব!
কেন তা হয় না?

যারা বিজনেস পড়ে এসেছেন, গড়গড় করে "টাইম ভ্যালু অব মানি, টাইম ভ্যালু অব মানি" মুখস্থ করেছেন, তারা কি কখনো প্রশ্ন করেছেন যে -- স্যার, কেন সময়ের সাথে সাথে টাকার মূল্য কমবে?
কেন এর বিপরীত হয় না?
আমরা কি চাইলে এর বিপরীত করতে পারি না?


১৬ কোটি মানুষের শ্রম যদি এক ফোঁটা করে leak হয়, ১৬ কোটি মানুষের যদি প্রতিদিন ১ টাকা সমপরিমাণ লস হয় -- এবং সেটা যদি কোনো বিশাল ব্যবসায়ীর পকেটে যায়, কিংবা সরকারের পকেটে -- প্রতিদিন ১৬ কোটি টাকা!
বড়লোক হতে হলে আপনার আর কিচ্ছু করতে হবে না -- ডাকাতিও করতে হবে না -- জাস্ট একটা ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন।
ব্যস!

অতীতে মানুষ স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহার করত। গোল্ড তো চাইলেই তৈরী করা যায় না যে, সরকার চাইলেই বাজারে স্বর্ণমুদ্রার পরিমাণ বৃদ্ধি করে দেবে! স্বর্ণমুদ্রার পরিমাণ fixed থাকতো, কিন্তু মার্কেটে ক্রেতা-বিক্রেতা বাড়তো। ফলস্বরূপ দ্রব্যমূল্য কমতো, টাকার মান বাড়তো।

তাই যতদিন মানুষ গোল্ডকে টাকা হিসেবে ব্যবহার করতো, ততদিন time value of money ছিল এরকম:
"সময়ের সাথে সাথে টাকার মান বাড়বে।"
অর্থাৎ, আজকালকার বইপত্রে যা পড়ায়, তার ঠিক উল্টা!

ততদিন পর্যন্ত সব ঠিক ছিল, যতদিন পর্যন্ত টাকা তৈরীর কাজ সরকারের হাতে ছিল না। যখনই তাদের হাতে সেটা কুক্ষিগত হয়ে গেল, তখন থেকেই তারা ভাংতি টাকা অচল করতে লাগলো, এবং মার্কেটে কাগজের নোট চালু করে দিলো। কারণ গোল্ড তো চাইলেই বানানো যায় না, কিন্তু কাগজের নোট তো চাইলেই ছাপানো যায়!

শুরু হলো উল্টোদিকে যাত্রা: স্লো পয়জনিঙের মত একটু একটু করে গোটা জাতিকে শোষণ করার ইতিহাস। পুঁজিবাদের ইতিহাস। জোচ্চুরির ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের ইতিহাস। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় "মহাশোষণের" ইতিহাস। আজও সেই শোষণ দুনিয়াব্যাপী চলছে।

সামনের পর্বে ফ্রি মার্কেট, সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক - এগুলোর রহস্য উন্মোচন করলে মুদ্রাস্ফীতি বুঝতে সহজ হবে।
এই পর্ব শেষ করি আমেরিকার ফোর্ড মোটর কোম্পানির মালিক হেনরি ফোর্ডের বিখ্যাত উক্তি দিয়ে:
"ভালো হয়েছে যে আমাদের জনগণ ব্যাঙ্কিং সিস্টেম ও অর্থব্যবস্থা বোঝে না। যদি তারা বুঝত, আমার বিশ্বাস কাল ভোর হবার আগেই (সরকারের বিরুদ্ধে) একটা বিপ্লব হয়ে যেত।"
- হেনরি ফোর্ড।


পর্ব-৭: "চাহিবামাত্র ইহার বাহককে একশত টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে" এবং সরকার কর্তৃক জনগণের গোল্ড চুরি
"চাহিবামাত্র ইহার বাহককে একশত টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে।"
কখনো কি ভেবে দেখেছেন, নোটগুলোতে কেন এই কথা লেখা থাকে?
কিংবা - ৫ টাকার নোটেও লেখা থাকে "চাহিবামাত্র ইহার বাহককে...", কিন্তু ৫ টাকার কয়েনে কেন লেখা থাকে না?
একটা ১০০ টাকার কাগজের নোট। সেটার বাহক কে? বাহক মানে যে ব্যক্তি বহন করে বা carry করে। সেটা হলেন আপনি। আপনি চাইলেই সাথে সাথে আপনাকে "একশত টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে" … কেউ একজন!
কে সে?
"গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বে প্রবর্তিত "আতিউর রহমান" গভর্নর।"
এত জটিল বাংলা কি জনগণ বোঝে? সোজা কথা হলো, আপনি যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে গিয়ে ১০০ টাকার নোট ফেরত দেন, সে আপনাকে ১০০ টাকা দিতে বাধ্য থাকবে!!
তারমানে ১০০ লেখা এই কাগজটা "টাকা" নয়! "টাকা" আছে গভর্নরের কাছে, আর আমি চাইলেই সে ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে - ওয়াদাও করছে! তারমানে আমার পকেটের এত কাগজ, এগুলো হলো টাকার - "মানি রিসিট"!
"আমার পকেটের এত এত কাগজ -- এগুলো টাকা না! আসল টাকা আছে গভর্নরের কাছে!" এই কথাটা দেশের প্রত্যেকটা মানুষ যদি জানতো, তাহলেও বোধহয় আগামীকাল ভোর হবার আগেই একটা বিপ্লব হয়ে যেত।

আচ্ছা, লন্ড্রিতে কাপড় দিলে যখন একটা স্লিপে লিখে দেয় - "তিনটা শার্ট ধুইতে দিছে মি. ওমুক"। ঐ স্লিপটাই কি শার্ট? আপনি কি কোনোদিন ঐ শার্ট ফেরত নিতে যাবেন না? নাকি ঐ কাগজকেই শার্ট বলবেন?
সেটাতো করেন না। তাহলে এইসব ১০০, ৫০০ লেখা মানি রিসিটকে কেন টাকা বলেন? যেখানে গভর্নর সাহেবই বলে দিচ্ছে যে, এইসব কাগজ টাকা না, আসল টাকা আছে উনার কাছে, আমরা গিয়ে চাইলেই উনি দিয়ে দেবে!
কী আশ্চর্য! বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সাহেব গোটা জাতির কাছে ওয়াদা করেই যাচ্ছে যে "আপনারা চাইলেই ফেরত দিয়ে দেব" -- কিন্তু আমরা কেউ-ই ফেরত চাইছি না! কী আশ্চর্য!
ব্যাংক: স্বর্ণমুদ্রার নিরাপত্তা প্রদানকারী থেকে ঋণদাতা
এখনকার আলোচনটা বুঝতে হলে আগের পর্বটা ভালভাবে বুঝতে হবে। এবার আমরা একটা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করব এবং দেখবো যে:
ব্যাংক কিভাবে গোল্ডকয়েন গচ্ছিত রাখার "সিকিউরিটি প্রোভাইডার" থেকে "ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানে" পরিণত হলো।

কাগজের নোটের কথা আপাতত ভুলে যান। মনে করেন, আমাদের সেই বটতলার মার্কেটে মোট ১০টা গোল্ড কয়েন আছে। এই দশটা গোল্ডকয়েনই বিভিন্ন ক্রেতাবিক্রেতার হাতে-হাতে ঘুরছে।
কিন্তু… ঐযে, দ্রব্য বিনিময় প্রথার সুবিধাও আছে, অসুবিধাও আছে, তেমনি গোল্ড কয়েনেরও সুবিধা-অসুবিধা আছে। একটা অসুবিধা হলো, এটা চুরি যায় সহজে।
তাই টাকমাথা সেই লোক একদিন এসে হাজির হলো। বললো,
"এই দেখ আমার কাছে লোহার তৈরী সিন্দুক আছে (ব্যাংকের ভল্ট)। আর এইযে দুইটা পাহারাদার আছে। আমার কাছে তোমাদের গোল্ড জমা রাখো। তাহলে আর চুরি যাবে না।"
লোকেরা ভাবলো, তাইতো! ঘরে এত এত গোল্ডকয়েন রাখার চেয়ে ব্যাঙ্কে রাখাই ভালো। আর যখন যেটুকু দরকার হবে, গিয়ে তুলে নিয়ে আসব। চুরি যাওয়ার রিস্ক নাই।
টাকমাথা: "কিন্তু... জাস্ট হালকা একটু ফি দিতে হবে। বছরে ১টা গোল্ডকয়েন দিলেই হবে।"
ব্যস! প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলো "গোল্ডকয়েনের সিকিউরিটি সার্ভিস প্রোভাইডার" প্রতিষ্ঠান: ব্যাংক!

ধরি, চালঅলার আছে - ৫০০ গোল্ড কয়েন।
ডালঅলার আছে - ৫০০ গোল্ড কয়েন। মুরগিঅলারও আছে ৫০০ গোল্ড কয়েন।
তিনজনই ব্যাংকে সব গোল্ড জমা রাখলো। ব্যাংকঅলা প্রত্যেককে একটা করে স্লিপ দিয়ে দিলো। স্লিপে লিখে দিলো:
"চাওয়ামাত্র চালঅলাকে ৫০০ গোল্ডকয়েন ফেরত দিতে বাধ্য থাকব"
- মালঅলা (সিগনেচার)।
এভাবে করে ডালঅলা আর মুরগিঅলাকেও একটা করে স্লিপ দিলো।
আবার বিরক্ত হয়ে ভাবছেন নাতো যে কী চালঅলা-ডালঅলা বটতলার গল্প ফেঁদে বসেছি। তাহলে [ছবিতে] দেখেন, ১৯২৮ সালের বিশ ডলারের নোট।
নোটে কী লেখা?

"This certifies that there has been deposited in the treasury of
The United States of America
TWENTY DOLLARS
In gold coin payable to the bearer on demand."
অর্থাৎ, সোজা বাংলায়:
"আমেরিকার সরকারী কোষাগারে ২০ ডলার দামের গোল্ড কয়েন জামা রাখা হয়েছে,
এই কাগজ হলো সেই জমার স্লিপ। এই কাগজ যার হাতেই থাকবে, সে চাওয়ামাত্র তাকে সেই গোল্ড কয়েন ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে সরকার।"
পরবর্তীতে মার্কিন বেসরকারী ব্যাঙ্ক "ফেডেরাল রিজার্ভ" যখন ডলার ছাপানোর দায়িত্ব গ্রহণ করে, তারা এই কথাগুলো বাদ দিয়ে দেয়। [দ্বিতীয় ছবি দেখুন।] অর্থাৎ, তারা আর গোল্ডকয়েন ফেরত দেবে না!
আমেরিকার জনগণের কাছ থেকে গোল্ডকয়েন সব নিয়ে ভল্টে জমা করে তারপর নোট ছাপতে ছাপতে… অনেক বছর পর হঠাৎ করে ঐ কথাটা মুছে দিলো: "in gold coin payable to the bearer on demand."

তার মানে কী? চালঅলা বিশ্বাস করে ৫০০ গোল্ড কয়েন সিকিউরিটির জন্য রেখেছিলো। আমি শুরুতে ওয়াদা করলাম যে গোল্ড কয়েন চাইলেই ফেরত দেব।
পরে বললাম, আমি গোল্ড ফেরত দেব না!
চালঅলা... "বিশ্বাস" করেছিলো!
পর্ব-৩ এ বলেছিলাম যে:
"ব্যস! টাকার উপরে মানুষের আস্থা তৈরী হয়ে গেল! এখন সেটাকে কাগজের টাকাই বলেন, কি স্বর্ণমুদ্রাই বলেন, কি রৌপ্যমুদ্রাই বলেন।
টাকা হয়ে গেল middle man। বিনিময়ের মাধ্যম। টাকার উপর সবার খুব ভরসা। খুব আস্থা।
এই "আস্থা" শব্দটা খুউব ভালো করে লক্ষ্য করবেন।"
এই আস্থাই তারা ভঙ্গ করেছে। কিন্তু খুউব কৌশলে। দুইটা ২০ ডলারের নোট হুট করে তাকালে একই মনে হবে। কিন্তু দেখেন, দ্বিতীয়টায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা নাই।
পার্থক্যগুলো বের করতে পারেন?

পর্ব-৮: ব্যাংক: গোল্ডকয়েনের সিকিউরিটি প্রোভাইডার থেকে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান
"চাহিবামাত্র ইহার বাহককে পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা দিতে বাধ্য থাকিবে বটতলা ব্যাংকের গভর্নর মালঅলা।"
একথাই একটা কাগজে লিখে চালঅলাকে দিয়েছিলো মালঅলা। বিনিময়ে মালঅলার ব্যাংকের ভল্টে ৫০০ গোল্ড কয়েন রেখেছিলো চালঅলা।
একইভাবে ডালঅলা, মুরগিঅলা - তারাও ৫০০ করে গোল্ডকয়েন রেখেছিলো।
তাদেরকেও একটা করে কাগজ দিয়েছিলো মালঅলা। সেখানেও ঐ একই কথা লেখা।

এটাই ছিল ইতিহাসের প্রথম ব্যাংক নোট।
যেটা ছিল গোল্ড জমা রাখার রশিদ মাত্র। এই কাগজের কোনো মূল্যই ছিল না। যেভাবে করে লন্ড্রিতে জামা দিয়ে আসলে ওরা একটা কাগজে আপনাকে লিখে দেয়, যেন পরে আপনি শার্ট ফেরত আনতে পারেন। যাহোক, এবার দেখি চাল-ডাল-মুরগিঅলা কিভাবে ব্যাংকের সাথে লেনদেন করে।
১. চালঅলার বাজারের টাকা
মাসের বাজার করতে হবে, চালঅলার আশি গোল্ডকয়েন দরকার। ব্যাংকে গিয়ে "চাহিবামাত্র ইহার বাহককে... ৫০০ গোল্ড..." লেখা কাগজটা ফেরত দিলো।
ব্যাংকঅলা ওকে আশি গোল্ডকয়েন দিলো। আর বাকি গোল্ডকয়েনের জন্য ৪২০ লেখা নোটটা দিয়ে দিলো (বিশ্বাস না হলে উপরের ছবিটা আবার দেখুন!)।
চালঅলা মহা আনন্দে বাজার করে। আর নিশ্চিন্তে ঘুমায় - তার বাড়িতে চোর আসবে না, সব গোল্ডকয়েন ব্যাংকের ভল্টে।
২. মুরগিঅলার ঋণ পরিশোধ
একদিন মুরগিঅলা যায় চালঅলার বাড়িতে। গিয়ে বলে, "সেইযে তোমার বিয়ের সময় ৪২০ গোল্ড কয়েন ধার দিসিলাম, মনে আছে? ঐটা ফেরত দাও।"
চালঅলা তখন ৪২০ টাকার নোটটা দেয় মুরগিঅলাকে। বলে, "এই নাও, এটা গিয়ে ব্যাংকে দিলেই তোমাকে ৪২০ গোল্ড কয়েন দিয়ে দিবে।"
একটু থামেন। কী ঘটলো? লেনদেন ঘটে গেল, কিন্তু গোল্ডকয়েন ছাড়াই! হাতে হাতে কী লেনদেন হলো? গোল্ডকয়েন? না। কাগজ। ব্যস! (এখনকার দিনে আমরা যে "bearer check" দেই, সেরকম।)
এইটা খুব ভালো করে লক্ষ্য করবেন। কারণ, ঐ ৪২০ লেখা কাগজের নোটের উপর চালঅলা আর মুরগিঅলা দুইজনেরই খুউব আস্থা। আর পরে আমরা এই আস্থারই সুযোগ নেব, ওদের গোল্ড চুরি করব!
৩. মুরগিঅলার অ্যাকাউন্ট
মুরগিঅলা ভাবে, এই কাগজ দিয়ে গোল্ড তুলে বাসায় রাখবো? তারচেয়ে কাগজটাই পকেটে রেখে দেই। যখন লাগবে, ব্যাংকে গিয়ে তো গোল্ডকয়েন তুলতেই পারব।
৪. মুরগিঅলার লেনদেন
মুরগিঅলা দুই হাজার মুরগির বাচ্চা কিনবে, দাম পাঁচশো গোল্ডকয়েন। ৮০ গোল্ডকয়েন ক্যাশ দিল, আর ৪২০ টাকার নোট দিয়ে বলল: "এইটা ব্যাংকে গিয়ে দিলেই ৪২০ গোল্ডকয়েন দিয়ে দেবে।"

পাঠক! আবার থামেন। দেখেছেন, কিভাবে কাগজের নোটের উপর আস্থা তৈরী হচ্ছে? আপনি না দেখলে কী হবে, মালঅলা তো ঠিকই দেখছে, আর মিটিমিটি হাসছে!
৫. মুরগির বাচ্চা বিক্রেতা
মুরগির ছাও বিক্রেতা ঐ ৪২০ টাকার নোট দিয়ে গোল্ডকয়েন তো নেয়-ই না, উল্টা সে-ও ভাবে, এই আশি গোল্ডকয়েনও ব্যাংকে জমা রেখে আসি।

এবার দেখব মালঅলার ব্যাংক কিভাবে "গোল্ডকয়েনের সিকিউরিটি প্রোভাইডার" প্রতিষ্ঠান থেকে "টাকা ধার দেওয়ার প্রতিষ্ঠানে" রূপান্তরিত হয়।
আর এইখানেই শুরু হবে টাকার খেলা: কাগজের নোটের ম্যাজিক (জোচ্চুরি)!
এবার হালকা ক্যালকুলেশান করে নেই।
হিসাব
ব্যাংকের ভল্টে মোট আছে -- ১৫০০ গোল্ড কয়েন।
কোন ক্লায়েন্টের কত গোল্ডকয়েন?
চালঅলা - ০ গোল্ডকয়েন
ডালঅলা - ৫০০ গোল্ডকয়েন
মুরগিঅলা - ৫০০ গোল্ডকয়েন
মুরগির ছাওঅলা - ৪২০ গোল্ডকয়েন + ৮০ গোল্ডকয়েন = ৫০০ গোল্ডকয়েন।
__________________
মোট - ১৫০০ গোল্ডকয়েন।
ক্লায়েন্ট সংখ্যা - ৩।

যেহেতু --
বটতলার লোকজন bearer check দেওয়ার মত করে ৪২০ টাকা, ৫০০ টাকা ইত্যাদি নোট ব্যবহার করছে, এবং গোল্ডকয়েনকে ভল্টে রেখে ঐ কাগজের নোটই আদান-প্রদান করছে, নোটকেই মূল্যবান হিসেবে দেখছে (কারণ, নোট মানেই গোল্ড!)
এবং যেহেতু --
তিনজন ক্লায়েন্টই কখনো একসাথে সব গোল্ড ফেরত চাইবে না/ উঠাবে না
সেহেতু --
মালঅলা শিওর হয়ে গেল যে, আমার ভল্টে সবসময় গোল্ড রিজার্ভ থাকবেই।
আবার একটু থামেন।
ওমুক দেশের গোল্ড রিজার্ভ কমে গেছে, কিংবা বাংলাদেশের ফরেন কারেন্সির রিজার্ভ এত ডলার… ইত্যাদি কথা কখনো নিউজে দেখেছেন?
এই রিজার্ভ হলো সেই রিজার্ভ। এবার মালঅলা থুক্কু ব্যাংক, ঋণ দেয়া শুরু করলো।
ঋণগ্রহীতা-১
ঋণগ্রহীতা-১: "মালঅলা, আমি গাড়ি কিনব। ৫০০ গোল্ডকয়েন লাগবে।"
মালঅলা: "ওকে, নো প্রবলেম। তবে একবছর পর আমাকে ৫০১ গোল্ডকয়েন ফেরত দিতে হবে। ঐ ১ গোল্ডকয়েনই আমার সামান্য লাভ।"
তারপর ঋণের চুক্তিপত্রে সই করে।
তারপর ব্যাংকের ভল্ট থেকে ৫০০ গোল্ডকয়েনের পুঁটলি এনে দেয় মালঅলা।
ঋণগ্রহীতা লোকটা গোল্ডকয়েনের পুঁটলি নিয়ে কিছুদুর গিয়ে আবার ফিরে আসে। বলে: "পথে যদি ছিনতাই হয়? তারচেয়ে আমার অ্যাকাউন্টে এই ৫০০ গোল্ডকয়েন রাখো, আর আমাকে ৫০০ টাকার একটা নোট দাও, গাড়ি বিক্রেতাকে আমি ঐ নোটটাই দিয়ে দেব। ও এসে ব্যাঙ্ক থেকে গোল্ডকয়েন তুলে নেবে।"
বেশতো!
ঋণগ্রহীতার হাতে ঋণ হিসেবে কী আছে? Not real gold, baby! কাগজ! গোল্ড জমা রাখার রশিদ! যেইটাকে আমরা টাকা/ ডলার/ ইউরো ইত্যাদি বলি! যেইটার উপর লেখা আছে: "চাহিবামাত্র..." কিংবা "in gold payable to the bearer on demand..."। (আগের পর্ব দেখুন)

হিসাব:
ব্যাংকের ছিল - ১৫০০ গোল্ডকয়েন
ধার দিলো - ৫০০ গোল্ডকয়েন
__________________________
ব্যাংকের আছে - ১,০০০ গোল্ডকয়েন
কিন্তু ভল্টে আছে: ১৫০০ গোল্ডকয়েন। (কেন? আশা করি বুঝেছেন হিসাবটা। কারণ যে ১৫০০ গোল্ডকয়েন আছে, তার মাঝে ৫০০ গোল্ডকয়েন হলো ধার দেওয়া গোল্ডকয়েন, ঋণগ্রহীতা সেটাকে ব্যাংকের কাছেই আমানত রেখেছে।)
ঋণগ্রহীতা-২
ঋণগ্রহীতা-২: "শুনলাম, ওমুককে নাকি কার লোন দিয়েছো। আমাকে হোম লোন দাও। আমি আর গোল্ডকয়েনের পুঁটলি নেব না, তুমি আমাকে ঐ কাগজই দাও।"
মালঅলা: "হুম... ওকে। এই নাও ৫০০ টাকার নোট।"
হিসাব:
ব্যাংকের ছিল - ১০০০ গোল্ডকয়েন
ধার দিলো - ৫০০ গোল্ডকয়েন
________________________
ব্যাংকের আছে - ৫০০ গোল্ডকয়েন
কিন্তু ভল্টে আছে: ১৫০০ গোল্ডকয়েন। (কারণ যে ১৫০০ গোল্ডকয়েন আছে, তার মাঝে মোট ১,০০০ গোল্ডকয়েন হলো ধার দেওয়া গোল্ডকয়েন, ঋণগ্রহীতা-১ ও ঋণগ্রহীতা-২ সেটাকে ব্যাংকের কাছেই আবার আমানত রেখেছে।)
ঋণগ্রহীতা-৩
ঋণগ্রহীতা-৩: "সবাই ঋণ নেয়, আমাকেও দাও।"
মালঅলা: "এই নাও, ৫০০ টাকার নোট।"
ঋণগ্রহীতা: "উঁহু। আগে তোমার ভল্ট খুলে দেখাও দেখি, ৫০০ গোল্ডকয়েন আছে, নাকি ভাঁওতাবাজি করতেছো?"
মালঅলা (সরল মুখ করে): "ভালোবেসে কী দোষ করেছি, বিশ্বাস করোনা আমায়...।" তারপর চাবি দিয়ে ভল্ট খুলে দেখায়: ১৫০০ গোল্ডকয়েন পড়ে রয়েছে।

হিসাব:
ব্যাংকের ছিল - ৫০০ গোল্ডকয়েন
ধার দিলো - ৫০০ গোল্ডকয়েন
______________________
ব্যাংকের আছে - ০ গোল্ডকয়েন
কিন্তু ভল্টে আছে: ১৫০০ গোল্ডকয়েন। (কারণ যে ১৫০০ গোল্ডকয়েন আছে, তার সবটাই হলো ধার দেওয়া গোল্ডকয়েন, ঋণগ্রহীতা-১, ২, ও ৩ তাদের ঋণ নেয়া গোল্ডগুলোই আবার ব্যাংকের কাছেই আমানত রেখেছে। এই পনরোশো গোল্ডকয়েন সে দ্বিতীয়বার ধার দিতে পারবে না। (এক জমি কয়জনের কাছে বেচবেন?) )

প্রিয় পাঠক! তাহলে, ব্যাংকের আছে কত? শূন্য গোল্ডকয়েন।
সে কি আর ধার দিতে পারবে?
না।
তার ভল্টে যে ১৫০০ আছে?
সেগুলো তো অলরেডি ঋণ দেয়া জিনিস, তার কাছে আমানত আছে শুধু। ঋণ দেওয়া জিনিস আবার ঋণ দেয় কেম্নে?
এবার…
ঋণগ্রহীতা-৪(!)
ঋণগ্রহীতা-৪: "৫০০ গোল্ডকয়েন দাও.."
মালঅলা: "এই নাও ৫০০ টাকার নোট।"
অ্যাঁ?
কী হলো?
শূন্যের উপর পাঁচশো গোল্ডকয়েন তৈরী করে ফেললো ব্যাংক!!
ঋণগ্রহীতা-৫(!!)
ঋণগ্রহীতা-৫: "১ হাজার গোল্ডকয়েন দাও।"
মালঅলা: "এই নাও ১ হাজার টাকার নোট: " চাহিবামাত্র ইহার বাহককে একশত স্বর্ণমুদ্রা দিতে বাধ্য থাকিবে বটতলা ব্যাংকের গভর্নর মালঅলা" ।"
ঋণগ্রহীতা-৬, ৭, ৮…
ঋণ, ঋণ, ঋণ…
ক্রেডিট, ক্রেডিট ক্রেডিট…
(এই পর্বে আর বিস্তারিত বলবো না। credit driven economy vs charity driven economy (or, Islamic economy) নিয়ে আরো পরে লিখব ইনশাআল্লাহ।

পাঠক! অনেক হিসাব দেখলাম। আপাততঃ এটুকু বোঝার চেষ্টা করেন। এবং বটতলার মার্কেটে এই ফাও নোটগুলো প্রবেশ করার রেজাল্ট কী হবে, এবং শেষমেষ ভোগ পোহাতে হবে কাকে -- সেটা বোঝার চেষ্টা করেন।
পরের পোস্টে সেটাই, অর্থাৎ ইনফ্লেশান আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

শুরু থেকেই ব্যাংকের ভল্টে মানুষ যে গোল্ডকয়েনগুলো রেখেছিলো, সেগুলো তো "আমানত" ছিলরে ভাই! আমানতের জিনিস কি ব্যবসায় খাটানো যায়, বলেন?
আমরা কিসের ইসলামিক ব্যাংকিং করব, আমরাতো কিছু জানিই না!

পর্ব-৯: স্বর্ণমুদ্রায় ফিরে যাওয়াই সমাধান
পর্ব ১ থেকে ৮ পর্যন্ত যা যা আলোচনা করলাম, তা থেকে নিচের সিদ্ধান্তে আসা যায়:
• দ্রব্য বিনিময় প্রথার অসুবিধাগুলো দূর করতেই টাকার উদ্ভব।
• টাকা হলো দ্রব্য বিনিময়ের মাধ্যম, medium of exchange।
• আমাদের শ্রম আমরা টাকার মধ্যে সঞ্চয় করে রাখি।
• একটা মার্কেটে মোট টাকার পরিমাণ অবশ্যই ফিক্সড হতে হবে। ফলে সময়ের সাথে সাথে টাকার মান বাড়বে।
• এই টাকা অবশ্যই গোল্ড বা সিলভারের মত মূল্যবান ধাতুর তৈরী হতে হবে। কেবলমাত্র সেক্ষেত্রেই মার্কেটে টাকার পরিমাণ ফিক্সড থাকবে। কেননা, গোল্ড চাইলেই তৈরী করা যায় না।
• টাকা এমন কোনো জিনিসের হতে পারবে না, যেটাকে চাইলেই তৈরী করা যায়। যেমন, কাগজ, কাপড়, প্লাস্টিক ইত্যাদি।
• এমনকি স্বর্ণমুদ্রা ব্যাংকে জমা রেখে তার এগেইনস্টে কাগজের নোটও নেয়া যাবে না, কারণ --
• ব্যাংকগুলো অবশ্যই তার কাছে থাকা গোল্ডকয়েনের চেয়ে অধিক পরিমাণ নোট ছাপাবে এবং ঋণ দেবে।
• অতএব, "গোল্ড-স্ট্যান্ডার্ড/ gold backed paper currency" হলো ভাঁওতাবাজির জায়গা, কেননা, ব্যাংকের জোচ্চুরি ঠেকানো বা চেক দেওয়ার মত কেউ নেই।

লেভেল-১: দ্রব্য বিনিময় প্রথা।
লেভেল-২: স্বর্ণমুদ্রার মাধ্যমে দ্রব্য বিনিময়।
লেভেল-৩: কাগজের নোটের মাধ্যমে দ্রব্য বিনিময়। কিন্তু প্রতিটা নোটের বিপরীতে সমান সংখ্যক গোল্ডকয়েন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোট ছাপায়। জনগণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক/ সরকারের উপর আস্থা রাখে।
লেভেল-৪: কাগজের নোটের মাধ্যমেই দ্রব্য বিনিময়, কিন্তু প্রতিটা নোটের বিপরীতে কোনো গোল্ড কয়েন নাই। সরকার ইচ্ছামত নোট ছাপে (আমরা বর্তমানে এই যুগে বসবাস করছি)। মার্কেটে মোট টাকার পরিমাণ আর ফিক্সড নাই। প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ফলে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে, টাকার মান কমছে। জনগণের নাভিশ্বাস।
লেভেল-৫: ক্রিপ্টোকারেন্সির উদ্ভব। কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকবে না। প্রত্যেকের মোবাইলে সফটওয়্যারের মাধ্যমে কারেন্সির হিসাব রাখা হবে। কেউ চাইলেই কারেন্সি তৈরী করতে পারবে না। কোটি কোটি ব্যবহারকারী সবাই সবাইকে চেক-এ রাখবে (অটোমেটিক সফটওয়্যারের মাধ্যমে)। সাধারণ জনগণকে পুরোপুরি সফটওয়্যারের উপর ডিপেন্ড করতে হবে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের আস্থা রাখতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর পরিবর্তে সফটওয়্যারের প্রোগ্রামারদের উপর।

পাঠক, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে, যত লেভেল আপ হচ্ছে, ততই টেকনোলজি উন্নত হচ্ছে, কিন্তু মানুষকে আস্থা রাখতে হচ্ছে ব্যাংক, সরকার, প্রোগ্রামার ইত্যাদির উপর।
আর আস্থা রাখা মানেই আস্থা ভঙ্গ হবার রিস্ক।
অতএব, আমাদেরকে মধ্যম লেভেলে ফিরে যেতে হবে, যেখানে আস্থার পরিমাণ খুব কম থাকবে, কিন্তু আবার দ্রব্য বিনিময় প্রথার অসুবিধাতেও আটকে থাকতে হবে না। আর সেটা হলো:
মানুষের হাতে হাতে গোল্ডকয়েন থাকবে। গোল্ডকয়েন দিয়েই মানুষ কেনাবেচা করবে। কেননা, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই-ই গোল্ড চেনে। এখানে জোচ্চুরির চান্স নেই। কেন্দ্রীয় কোনো ব্যাংক/ সরকারের কন্ট্রোল নেই। মানুষ যা শ্রম দেবে, তা-ই স্বর্ণমুদ্রায় সঞ্চয় করবে। এটাই হলো আদর্শ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা/ মুদ্রাব্যবস্থা।

ভাবছেন, আমরা ফেইসবুক, বিকাশ আর অনলাইন মানি ট্রান্সফারের যুগে বসেও পুঁটলিতে করে স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে ঘুরব? আদিম যুগে ফিরে যাবো?
যদি এমনটা ভেবে থাকেন, তবে অবশ্য দোষ দেব না আপনাকে। কেবল আরো কতগুলো পর্বের পরে জানাবো যে, বিশ্বের বড় বড় দেশ এখন স্বর্ণমুদ্রায় ফিরে যাচ্ছে, এক দেশের সাথে অন্য দেশ গোল্ড দিয়ে দ্রব্য কেনাবেচা করছে, এবং পাগলের মত করে সারা দুনিয়া থেকে গোল্ড কিনে জমানো শুরু করেছে। কেননা, সরকারগুলো জানে, দুনিয়াব্যাপী কাগজের নোটের মূল্যহীন হয়ে যাওয়ার কী মহা বিপদ সামনে আসছে।

পর্ব-১০: মার্কেটে টাকার পরিমাণ বাড়লে দ্রব্যমূল্য বাড়ে, এবং সরকার অতিরিক্ত নোট বাজারে প্রবেশ করায় যেভাবে
সরকারের এখন অনেক টাকা দরকার। প্রত্যেক রাস্তার উপর ফ্লাইওভার বানাবে। মেট্রোরেল তৈরী করবে। পদ্মাসেতু করবে।
সরকার: "হে মালঅলা! তোমার ব্যাঙ্ক থেকে আমাকে কয়েক কোটি টাকা ধার দাও!"
মালঅলা (ব্যাংক): "এই নাও চার হাজার কোটি টাকা মাত্র। কেবলই গরম গরম ছাপিয়ে আনলাম ছাপাখানা থেকে। তবে… ৫% সুদসহ ফেরত দিতে হবে কিন্তু!"
সরকার: "নো প্রবলেম! প্রাইভেট ভার্সিটির উপর ৭% ট্যাক্স বসাবো, মোবাইলে কলের উপর ৫% ট্যাক্স বসাবো, সেগুলো থেকে শোধ করে দেব।"
তারপর…
তারপর সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট করে। এই নতুন ছাপানো ভুয়া নোটগুলো (যার বিপরীতে কোনো গোল্ড নাই) জনগণের হাতে আসে, ঠিকাদারদের হাতে আসে, সরকারী লোকজনের হাতে আসে।
সরকারী ঠিকাদাররা গরম গরম নোট বাড়িতে নিয়ে যায়। নতুন বিয়াল্লিশ ইঞ্চি টিভি কেনে, আইফোন কেনে, ফ্রিজ কেনে। রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করে। গাড়িও কেনে। কক্সবাজার ঘুরতে যায়। থাইল্যান্ড ঘুরতে যায়…
অর্থাৎ, মানুষের হাতে বেশি টাকা আসলে সে বেশি খরচ করে।
এবার দেখি কে কাকে টাকা দিচ্ছে।
প্রিন্টিং মেশিন → ব্যাঙ্ক
ব্যাঙ্ক → সরকার
সরকার → ঠিকাদার (রাস্তা, ব্রিজ, ইত্যাদির কন্ট্র্যাক্টর)
ঠিকাদার → পিঁয়াজঅলা।

এইবার একটু হিসাব করতে হবে আবার। পিঁয়াজের কেজি ছিল ধরেন ৫০ টাকা করে। টাকা হাতে আসলে যা হয় আরকি, ঠিকাদারের বউ এখন মাছ-মুরগি সবই বেশি বেশি পিঁয়াজ দিয়ে ভুনা করতে চায়। অতএব, ঠিকাদার গিয়ে বেশি বেশি পিঁয়াজ কেনে। এরকম ৫০০ ঠিকাদার গিয়ে বেশি বেশি পিঁয়াজ কেনে।
প্রত্যেক ঠিকাদারই কয়েকশো কেজি পিঁয়াজ কিনে নিয়ে গেল বাড়িতে। পরদিন...
পিঁয়াজঅলা (মনে মনে): “হুমম... পিঁয়াজের বিক্রি বেড়ে গেছে। দাম বাড়িয়ে দেই, লাভ হবে বেশি।” পরেরদিন আপনি দোকানে গেলেন।
"ভাই, পিঁয়াজের কেজি কত?"
-- "সত্তুর টাকা।"
"অ্যাঁ? গতকালও না পঞ্চাশ টাকা ছিল!"
আপনিতো আর পিঁয়াজের ভুনা খান না। আপনার যেটুকু না হলেই নয়, সেটুকুই কিনতে হয়। তখন বাধ্য হয়ে বেশি দাম দিয়ে কেনেন। তারমানে আগে এককেজি পিঁয়াজের জন্য যেটুকু পরিশ্রম করতে হতো (১ ঘন্টা মাটি কাটতে হতো), এখন সেই একই পরিমাণ পিঁয়াজের জন্য আপনাকে আরো বেশি পরিশ্রম করতে হবে (দেড় ঘন্টা মাটি কাটতে হবে, যেন ৭০ টাকা কামাতে পারেন)।
ওদিকে ঠিকাদাররা যখন অনেক পিঁয়াজ কিনেছিলো, বাজার করেছিলো, টিভি ফ্রিজ কিনেছিলো, দেশ বিদেশ ঘুরেছিলো... তখন কিন্তু দাম কম ছিল সবকিছুর!
ওরা যখন বেশি বেশি খরচ করা শুরু করলো, তখন --
তখন ব্যবসায়ীরা টাকার গন্ধ পেলো। যেটাকে বলে: 'মার্কেট সেন্স করা/ মার্কেট ফিল করা' বা মার্কেটের অবস্থা বোঝা।
মার্কেট ফিল করে যখন বুঝলো যে "more money in circulation", অর্থাৎ আগের চেয়ে অধিক টাকা মার্কেটে প্রবেশ করেছে, মানুষের হাতে হাতে ঘুরছে (অর্থাৎ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে), তখন দিলো দাম বাড়িয়ে। আর পরেরদিন ঘুম থেকে উঠে আপনি জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে দেখেন, দাম আকাশছোঁয়া। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে পেটে লাথি পড়লো আপনার।
মার্কেটে মোট টাকার পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকেই মুদ্রাস্ফীতি বলে। এর ফলে সাধারণ জনগণের নাভিশ্বাস ওঠে। কারণ তাদের বেতন দ্রব্যমূল্যের সাথে তাল দিয়ে বাড়ে না।

গোটা প্রসেসটা নিম্নরূপ:
• গুটিকয়েক লোকের হাত দিয়ে মার্কেটে অতিরিক্ত টাকা প্রবেশ করে।
• ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত টাকার গন্ধ পায়।
• জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়।
• পরদিন ঘুম থেকে উঠে বাজারে গিয়ে আপনি বাধ্য হয়ে বেশি দামে জিনিস কেনেন।
• পেটে লাথি পড়ে আপনার।

উপরে একটা সরলীকৃত উদাহরণ দেখালাম। মার্কেটে টাকা বৃদ্ধি পাওয়ার পিছনে যেসব মেকানিজম আছে, ব্যাঙ্কগুলো তাতে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এবং শুধুমাত্র সরকার আর সরকারী প্রজেক্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী না, দায়ী আমরাও, যারা ব্যাঙ্ক থেকে নানান প্রয়োজন ঋণ নেই (আমরা অসচেতনভাবে দায়ী, মূলতঃ দায়ী ব্যাঙ্ক, যারা একই টাকা দশজনকে ঋণ দেয়)।
বিগত একটা পোস্টে বলেছিলাম: "একই জমি কয়জনের কাছে বেচবেন? একই জিনিস কয়জনের কাছে ঋণ দেবেন? আমানত কি ঋণ দেয়া যায়?" -- এটাই হলো সূত্র। ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের জোচ্চুরি ধরার সূত্র, এবং কেন দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়,  সেটা বোঝার সূত্র। কিন্তু এই সূত্রটার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। ভবিষ্যতে সেটা দেবার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

পর্ব-১১: মুদ্রাস্ফীতির উপর আলোকপাত: "দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাবে" - এটা sense করলে মানুষ দ্রুত টাকা খরচ করে asset জমা করে
কিছুদিন আগে ঢাকায় ৩ টাকা পিস ডিম বিক্রিকে কেন্দ্র করে অনেক কিছু হয়ে গেছে। ঐদিনে অনেকেই সস্তায় ডিম কিনতে গিয়েছিলো, এবং পরে সেখানে গণ্ডগোল হয়েছে। তাই নিয়ে নিচু মানসিকতার লোকেরা বাঙ্গালীকে জাত খারাপও বলেছে ফেইসবুকে। আদতে তারা অর্থনীতি বোঝে না, এবং এরাই হলো প্রকৃত বলদ, যদিও তারা সেটা বোঝে না, জাহালে মুরাক্কাব। সে যাহোক।
ধরেন, আগামীকাল ডিমের দামে ৫০% ছাড়। আপনি যাবেন লাইন দিয়ে কিনতে?
উমম... মেবি না। আপনার মান সম্মান প্রেস্টিজ আছে না!
আচ্ছা, ধরেন একইসাথে আগামীকাল মুরগির দামেও ৫০% ছাড় দেয়া হাবে। যাবেন?
-- "গেলে খারাপ হয় না, কিন্তু লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে... মান সম্মানের ব্যাপার। আচ্ছা বাদ।"
ওকে। এবার ধরেন আগামীকাল আইফোনে ৫০% ছাড় দেয়া হবে। সেজন্য বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে এক বিশাল তাহাজ্জুদ নামাজের আয়োজন করা হয়েছে, যেন তাহাজ্জুদ পড়েই সবাই লাইনে দাঁড়াতে পারে।
-- "ওয়াও! তাই নাকি? তাহলে যাই, বসুন্ধরা সিটিতে জামাত করে এশার নামাজ পড়ি। দশটা বন্ধুকেও খবর দেই। লাইনে দাঁড়াবো? ব্যাপারই না!"
এখন কিন্তু আপনাকে কেউ ফকিন্নির জাত বলবে না! ঐ গরীব খেটে খাওয়া মানুষ, একইদিনে যারা সস্তায় ডিম কিনতে লাইনে দাঁড়িয়েছে, তারা যদি জানতেও পারে যে ঢাকার অন্য প্রান্তে বসুন্ধরা সিটিতে আপনারা রাত থেকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন -- তবুও কিন্তু তারা আপনাকে ফকিন্নির জাত বলবে না।
কেন বলবে না জানেন? কারাণ ওরা মানুষ। দিলটা আমাদের চেয়ে অনেক বড়, অহঙ্কারমুক্ত।

সে যাকগে। আমি ভিন্ন কথা বলতে এই প্রসঙ্গের অবতারণা করেছি।
তো, আগামীকাল ডিম, মুরগি ও আইফোন -- তিনটাই ৫০% কম দামে বিক্রি হবে। এখন আমি যদি আপনার কাছে টাকা ধার চাই, দেবেন?
নাহ। আপনি টাকা জমিয়ে রাখবেন, আগামীকাল খরচ করার জন্য।
এবার ঘটনাটা উল্টে দেই। ধরেন, আগামীকাল মুরগি, ডিম ও আইফোনের দাম দ্বিগুণ হবে।
এখনও কি আপনি আগামীকালের জন্য টাকা জমিয়ে রাখবেন?
প্রশ্নই আসে না! যত দ্রুত পারবেন আজকেই ডিম, মুরগি, আইফোন ইত্যাদি কিনে নিতে। কারণ আগামীকাল থেকেই দাম বেড়ে যাচ্ছে।
রমজান মাস আসলে আমরা কী করি? আগে আগেই ছোলা, বেসন, পিঁয়াজ ইত্যাদি বেশি বেশি করে কিনে রাখি। কেন?
কারণ দাম বেড়ে যাবে যে! সেটা জানার কারণে আমরা আগে আগে টাকা খরচ করে ফেলি। নাহলে কিন্তু আগে আগে খরচ করতাম না: যখন যেটুকু দরকার, তখন সেটুকুই কিনতাম।

অর্থাৎ, টাকার মান কমে যাবে (দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাবে) -- এটা বুঝতে পারলে মানুষ দ্রুত টাকা খরচ করে "জিনিস" কেনার চেষ্টা করে।
টাকার মান বেড়ে যাবে (দ্রব্যমূল্য কমে যাবে) -- এটা বুঝতে পারলে মানুষ টাকা জমিয়ে রাখার চেষ্টা করে, যেন ভবিষ্যতে কমদামে জিনিস কিনতে পারে।

দ্রব্যমূল্য কমে কিভাবে? মার্কেটে টাকার পরিমাণ ফিক্সড থাকলে + মার্কেটে ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা বাড়লে।
আর দ্রব্যমূল্য বাড়ে কিভাবে? মার্কেটে অতিরিক্ত টাকা প্রবেশ করলে। সরকার কিভাবে সেই অতিরিক্ত টাকা মার্কেটে প্রবেশ করায়, এবং তাতে কিভাবে আপনার-আমার মত সাধারণ মানুষের পেটে লাথি পড়ে, সেটা গত পর্বে দেখিয়েছি।

জার্মানিতে ১৯২৩ সালে চরম মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছিলো (আল্লাহর পক্ষ থেকে না, সরকারের পক্ষ থেকে।) তখন প্রতিদিন দ্রব্যমূল্য ডাবল হচ্ছিলো (অর্থাৎ টাকার মান অর্ধেক হচ্ছিলো)। ১৯২৩ সালের জানুয়ারিতে একটা পাউরুটির দাম ছিল ২৫০ মার্ক (জার্মান নোটের নাম)। নভেম্বরে সেটা কিনতে ২০ হাজার কোটি মার্ক ব্যয় করতে হচ্ছিলো। সুটকেস ভর্তি কাগজের নোট -- এক লোকের মাসের বেতন -- ভুলে ফেলে রেখে গিয়েছিলো, চোর নোটগুলো ফেলে দিয়ে সুটকেসটা নিয়ে গিয়েছিলো। শেষে সরকার ১০ ট্রিলিয়ন মার্কের নোটও ছাপায়। কিন্তু লাভ কী?
১৪৪টা প্রিন্টিং প্রেসের সবগুলো দিনরাত নোট প্রিন্ট করছিলো। তাতেও কুলিয়ে উঠতে না পেরে শেষে কাঠ, কাপড় ইত্যাদিতে নোট প্রিন্টিং শুরু হলো। তারপর... মানুষজন দেখলো যে, কাগজের নোট দিয়ে যেটুকু কাঠ কেনা যাবে, তারচেয়ে কাগজের নোট পুড়ালে লাভ বেশি, তাই ঘর গরম রাখতে কাগজের নোটই পুড়ানো শুরু করলো মানুষ।
যেহেতু প্রতিদিন দাম বাড়ছে, সবাই পাগলের মত টাকা খরচ করে জিনিস কেনা শুরু করলো। যেন টাকা একটা অপবিত্র জিনিস, ভয়ানক জিনিস, কিংবা জ্বলন্ত কয়লা -- হাত থেকে ফেলতে পারলেই বাঁচে!
আমরা যেমন এখন নিশ্চিন্তে ফেইসবুক চালাচ্ছি, জার্মানির মানুষজন তখন নিশ্চিন্তে পত্রিকা পড়তো। তারপর একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করলো -- অবস্থা বেগতিক! যে পত্রিকার দাম ছিল ১ মার্ক, সেটা এক বছরের মাথায় ৭ কোটি মার্ক দিয়ে কিনতে হতো।
আমাদেরও যে হঠাৎ একদিন ওভাবে মাথায় বাজ পড়বে না, তা কি আমরা জানি? হয়ত হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখব ফেইসবুক চালানোর নেটের বিল, কারেন্ট বিল কোটি টাকায় দিতে হচ্ছে!
ভাবছেন, ওগুলো সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের ঘটনা। একশো বছর আগে। ফেইসবুক-ইউটিউবের আধুনিক যুগে এগুলো হবে না?
তাহলে জিম্বাবুয়ের দিকে তাকান!
আচ্ছা, আমাদের দেশের দিকেই তাকান না! আচ্ছা থাক, এত হিসাব একবারে মাথায় নিতে পারবেন না। সেটা নাহয় পরের পর্বে বলব।
কিন্তু আমাদের দেশ/ জাতির ভবিষ্যতকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে আমরা কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছি?
উঁহু। আমরাতো ব্যস্ত গরীব মানুষকে ফকিন্নির জাত বলে স্ট্যাটাস দিতে!

পর্ব-১২: স্বাধীনতা কেবলই ছলনা: ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের দাসত্বের শেকলে আমরা আজও বন্দী
বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ‌১৯৭১ সালে। কিন্তু কী আশ্চর্য! যে অর্থনৈতিক শোষণ ও জুলুম থেকে মুক্তি পেতে স্বাধীনতা যুদ্ধ -- সেই জুলুম ও শোষণ থেকে মুক্তি মিললো কি? কেমন জুলুম-শোষণের শিকার ছিল পূর্ব পাকিস্তানীরা? চাকরিতে বৈষম্য, আর শ্রমের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া। কিন্তু স্বাধীনতা আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিলো কি?
না। ব্যাংক নামক ভয়াবহ দানবের দাসত্বের শেকলে বন্দী হয়ে পড়লাম আমরা। ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের দাসত্বের শেকলে বন্দী জনগণের কেবল মনিব চেইঞ্জ হতে লাগলো: পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলার আজকে পর্যন্ত।

১৯৭২ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবু সায়ীদ চৌধুরীর নির্বাহী আদেশ নং ১৭২ এর ক্ষমতাবলে "বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২" ঘোষিত হয়। গোড়া থেকেই unbacked, floating fiat currency হিসেবে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশী টাকা। অর্থনীতির সেসব শব্দের ব্যাখ্যায় নাহয় পরে যাবো।

কিন্তু দেখেন, আপনার-আমার মত কোটি কোটি সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের শ্রমের ফসলই এই বাংলাদেশ। আর আমাদের শ্রমকে আমরা সঞ্চয় করে রাখছি যেই "টাকা"-তে, সেই টাকা সংক্রান্ত সকল নিয়ম নীতি তৈরী করলো এমন কিছু মানুষ -- যাদের নামই আমরা জানি না। যারা আমাদের মতামতও নেয়নি, বাংলাদেশের মুদ্রাব্যবস্থা কেমন হবে সে ব্যাপারে। ১৯৭২ সালের ৩১শে অক্টোবর যখন "বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২" ঘোষিত হয় -- ঠিক ঐদিন থেকেই অফিশিয়ালি গোটা জাতিকে নীরবে শোষণ করার "আইনত বৈধ" অধিকার হাতে তুলে নেয় সরকার/ কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আমরা সবাই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ঘোষক, ছয় দফা -- এগুলো নিয়ে মাতামাতি করি। কিন্তু নিতান্তই নিঃশব্দে একটি গেজেট প্রকাশ করে যে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আপনার-আমার শ্রম চুরি করাকে বৈধ করে নিলো -- তা আমরা জানি না। আজও না!

• সাত কোটি মানুষের দেশে ৩ কোটি "টাকা" নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক/ সরকার। (অনুচ্ছেদ 4-1)
(এখন থেকে ব্যাংক ও সরকারকে একই সাপের দুই মাথা হিসেবে কল্পনা করলে আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে।)
• সেই "বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারে" আরো লেখা ছিল যে, সরকারের অনুমোদনসাপেক্ষে ব্যাংক ইচ্ছামত নোট ছাপতে পারবে। (অনুচ্ছেদ 4-3)
• আরো লেখা ছিল যে, এই সমস্ত টাকা সরকারকে দেবে ব্যাংক, এবং সরকার সেটাকে বিভিন্ন খাতে ব্যয় করবে। (অনুচ্ছেদ 4-2)

আজও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গেলে সেসব কথা দেখতে পাবেন।

১৯৭২ সালে যেই ব্যাংক ৩ কোটি টাকা প্রিন্ট করে,
সেই একই ব্যাংক বিয়াল্লিশ বছরের মাথায় শুধুমাত্র ২০১৩-১৪ অর্থবছরেই ৮৪ হাজার কোটি টাকা প্রিন্ট করে! আর আবুল মাল সাহেব বলেন, চার হাজার কোটি টাকা "মাত্র"।

যেখানে সাত কোটি মানুষ মোট ৩ কোটি টাকার নোট ও কয়েন দিয়ে সব লেনদেন সারছিলো, সেখানে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হলো যখন, তখন নোটসংখ্যা দ্বিগুণ হলেও কথা ছিল, কিন্তু তা না হয়ে কেন হাজার গুণ বৃদ্ধি পেল? কী এমন বিশেষ দরকার পড়েছিলো?

আগের পর্বগুলোতে দেখিয়েছি যে, মুদ্রাস্ফীতি কিভাবে জনগণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সরকার ইচ্ছামত নোট ছাপায়, বিভিন্ন প্রজেক্টে খরচ করে, সেই অতিরিক্ত টাকা সরকারী প্রজেক্টের লোকদের হাত দিয়ে মার্কেটে প্রবেশ করে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, আর পরদিন আপনি ঘুম থেকে উঠে গিয়ে দেখেন, পিঁয়াজের বাজারে আগুন! পেটে লাথি পড়ে আপনার।

আরো দেখিয়েছি যে, বাজার থেকে ভাংতি টাকা হারিয়ে গেলে কিভাবে করে জনগণের শ্রম চুরি হয়ে যায়, শ্রম leak হয়ে যায়। ১৬ কোটি মানুষ ভাংতির অভাবে দৈনিক ১ টাকা করে লস করলেও প্রতিদিন ১৬ কোটি টাকা গুটিকয়েক মানুষের পকেটে গিয়ে জমে।

আজকে একটু ইতিহাস দেখেন যে, বাংলাদেশী টাকার মান কিভাবে কমেছে স্বাধীনতার পর থেকে।

১৯৭১ সালে ১ ডলার = ৭.৫ টাকা ছিল।
২০১৭ সালে আজকে ১ ডলার = ৮২ টাকা।

১৯৭৫ সালে সরকার ডলারের বিপরীতে টাকার ৫৬% অবমূল্যায়ন ঘোষণা করে।
১৯৮০-৮৩ সালে টাকার মুল্য আরো ৫০% কমে।

গোড়া থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের নোটে "চাহিবামাত্র ইহার বাহককে... টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে" লেখা হয়ে আসছে। কেন জানেন? কারণ আমাদের দেশের ব্যাংকাররা আর কিছুই না, আমেরিকা-ব্রিটেনের থেকে কপি-পেস্ট করে দিয়েছে।

পর্ব-৭ এ দুটো ডলারের ছবি দিয়ে দেখিয়েছিলাম যে, প্রথমদিকের ডলারগুলো ছিল "গোল্ড বিল" বা গোল্ড জমা রাখার রশিদ মাত্র, সেগুলো জমা দিলেই আমেরিকার সরকার গোল্ড দিত, কিন্তু পরবর্তীতে তারা গোল্ড ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায়, সুকৌশলে ঐ লেখাটি মুছে দেয়। ফলে ইচ্ছামত নোট ছাপাতে আর কোনো বাধা থাকলো না। এরপর থেমে মার্কিন অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি শুরু হয়, এবং ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা সেই মুদ্রাস্ফীতিরই ফসল।

বাংলাদেশ ব্যাংক আর গোল্ড থেকে শুরু করে পরে ফেরত না দেয়ার জোচ্চুরি করেনি -- শুরু থেকেই ইচ্ছামত ভুয়া নোট ছাপানোর বৈধতা দিয়ে গেজেট পাশ করে যাত্রা শুরু করেছে। তাই বাংলাদেশীরা কখনোই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গিয়ে "চাহিবামাত্র ইহার বাহককে..." লেখা অনুযায়ী কোনো "টাকা" পায়নি গভর্নের কাছ থেকে, পাবেও না। তারা একটা চক্র তৈরী করে দিয়েছে, এবং আমেরিকান ভুয়া ডলারের দেখাদেখি একটা কথা লিখে দিয়েছে। তারপর থেকে চলছে সমানে নোট ছাপানো। আর গরিবের পেটে লাথি মারা।

এর আগে পর্ব-৮ এ দেখিয়েছিলাম যে, ব্যাঙ্ক কিভাবে "গোল্ডকয়েনের সিকিউরিটি সার্ভিস প্রোভাইডার" থেকে "ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানে" পরিণত হয়েছিলো। এবং ভল্টে থাকা একই গোল্ড বহু মানুষকে ঋণ দেয়ার ভাঁওতাবাজি করেছিলো।

আর মুদ্রাস্ফীতির আলোচনায় বলেছিলাম যে, শুধুমাত্র সরকার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ছাপিয়ে মার্কেটে ঢুকানোই মুদ্রাস্ফীতির কারণ না, মার্কেটে অতিরিক্ত টাকা প্রবেশের জন্য আমরাও দায়ী, এবং এই ব্যাপারটা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেবার মাধ্যমে ঘটে থাকে (পর্ব-১০)।

ব্যাংক ঋণ দেবার মাধ্যমে কিভাবে মুদ্রাস্ফীতি ঘটায়, সেটা সামনের পর্বে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। এই পর্ব থেকে কয়েকটা key point মনে রাখতে পারেন:
• বাংলাদেশী টাকার বিপরীতে কখনোই কোনো গোল্ড ছিল না
• সরকারী গেজেট পাবলিশ করে নিজেকে ইচ্ছামত নোট ছাপানোর বৈধতা দিয়েছে সরকার/ব্যাংক
• ৩ কোটি টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু করে আজকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা প্রিন্ট করেছে ও করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক
• সরকারের হাত দিয়ে এবং বিভিন্ন বেসরকারী ব্যাংকের ঋণের মাধ্যমে এই টাকাগুলো মার্কেটে প্রবেশ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটায়, এবং খেটে খাওয়া মানুষের পেটে লাথি পড়ে: তারা বাধ্য হয় দুমুঠো ভাত যোগাতে আগের চেয়েও বেশি পরিশ্রম করতে।

পর্ব-১৩: ব্যাংক কেন সবাইকে loan দিতে চায়? সরকার কেন ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করে? দুটি রহস্য
ব্যাংক কেন সবাইকে loan দিতে চায়? এবং... ১০০ টাকাকে ১,০০০ টাকায় রূপান্তর করার উপায়…

মনে করেন, আপনি ব্যাঙ্কে ১০০ টাকা জমা রাখলেন। ধরেন, সরকারী আইন অনুযায়ী কমপক্ষে ১০% রেখে বাকিটা ঋণ দিতে পারবে ব্যাংক (এটাকে বলে রিজার্ভ রেশিও)। এবার একটু সিরিয়াস হিসাবের জন্য প্রস্তুত হন। কারণ আমরা একশো টাকাকে এক হাজার টাকা বানাবো (!)।
১ম লেনদেন
ব্যাঙ্ক রাখলো - ১০ টাকা (১০০ এর ১০%)।
ঋণ দিলো - ৯০ টাকা (চালঅলাকে)।

ব্যাঙ্কের হিসাব:
.....(জমা রেখেছি).......|.....(ঋণ দিয়েছি)
প্রথম ক্লায়েন্টের - ১০০..|.....চালঅলাকে - ৯০
ভল্টে থাকলো = ১০ টাকা।
২য় লেনদেন
চালঅলা ৯০ টাকা দিয়ে ট্রাক্টর কিনলো।
ট্রাক্টরঅলা গিয়ে ঐ একই ব্যাঙ্কে ৯০ টাকা জমা রাখলো।
ব্যাঙ্ক রাখলো - ৯ টাকা (৯০ এর ১০%)।
ঋণ দিলো - ৮১ টাকা (মুরগিঅলাকে)।

ব্যাঙ্কের হিসাব:
.....(জমা রেখেছি).......|.....(ঋণ দিয়েছি)
প্রথম ক্লায়েন্টের - ১০০..|..... চালঅলাকে - ৯০
ট্রাক্টরঅলার - ৯০..........|.....মুরগিঅলাকে - ৮১
ভল্টে থাকলো ১০+৯ = ১৯ টাকা।
৩য় লেনদেন
মুরগিঅলা ৮১ টাকা দিয়ে কীটনাশক কিনলো।
কীটনাশকঅলা গিয়ে ঐ একই ব্যাঙ্কে ৮১ টাকা জমা রাখলো।
ব্যাঙ্ক রাখলো - ৮ টাকা (৮১ এর ১০%)।
ঋণ দিলো - ৭৩ টাকা (আলুঅলাকে)।
ভল্টে থাকলো ১৯+৮ = ২৭ টাকা।

ব্যাঙ্কের হিসাব:
.....(জমা রেখেছি).......|.....(ঋণ দিয়েছি)
প্রথম ক্লায়েন্টের - ১০০..|..... চালঅলাকে - ৯০
ট্রাক্টরঅলার - ৯০..........|.....মুরগিঅলাকে - ৮১
কীটনাশকঅলার - ৮১....|.....আলুঅলাকে - ৭৩

তাহলে, শেষমেষ কী দাঁড়ালো?
ব্যাঙ্কের হাতে আছে ২৭ টাকা, আর আলুঅলার হাতে আছে ৭৩ টাকা। মোট ১০০ টাকা। যেই ১০০ টাকা আপনি জমা রেখেছিলেন।
কই, ১০০ টাকাতো একশই র’য়ে গেল, এক হাজার তো হলো না? আচ্ছা আসেন এবার এক হাজার বানাই। ঋণের হিসাবটা বাদ দিচ্ছি আপাততঃ।
১০০ থেকে ১,০০০
ব্যাঙ্কের হিসাব:
......(জমা রেখেছি)
প্রথম ক্লায়েন্টের - ১০০
ট্রাক্টরঅলার - ৯০
কীটনাশকঅলার - ৮১
_________________
মোট = ২৭১ টাকা। কই, এক হাজার তো হলো না? সমস্যা নাই। ১০০ টাকা বেড়ে ২৭১ তো অন্তত হয়েছে! এবার দেখেন...
সর্বশেষ আলুঅলা যে ৭৩ টাকা নিয়ে গিয়েছিলো, সেটা কিন্তু একহাত ঘুরে ব্যাঙ্কে আসে নাই। যদি সেটা ধরেন, ডিমঅলার হাত ঘুরে ব্যাঙ্কে এসে জমা হতো, নতুন হিসাব হতো:
ব্যাঙ্কের হিসাব:
.....(জমা রেখেছি)
প্রথম ক্লায়েন্টের - ১০০
ট্রাক্টরঅলার - ৯০
কীটনাশকঅলার - ৮১
ডিমঅলার - ৭৩
_________________
মোট = ৩৪৪ টাকা। কি, টাকা বাড়লো?
তিনজন ক্লায়েন্টের মোট জমা ছিল - ২৭১
চারজন ক্লায়েন্টের মোট জমা হলো - ৩৪৪
পাঁচজন ক্লায়েন্টের মোট জমা হবে - ৪১০
...
এভাবে করে ৪৫তম ক্লায়েন্টে গিয়ে ১,০০০ টাকা হয়ে যাবে।
এখন, কী ঘটবে, যদি ৪৫ জন ক্লায়েন্ট একসাথে গিয়ে সবাই যার যার টাকা দাবী করে? ব্যাংক কোত্থেকে এক হাজার টাকা দেবে!
মজার ব্যাপার হলো, ক্লায়েন্ট গিয়ে চাইলেই ব্যাঙ্ক টাকা দেয়। ব্যাঙ্ক কিন্তু বলে না যে, তোমাদের প্রত্যেকের জমা থেকে আমি মোট ৪৪ জনকে ঋণ দিয়েছি, ওরা টাকাগুলো শোধ করলেই তোমাদেরকে দিয়ে দেব! ব্যাঙ্ক ৪৫ জন ক্লায়েন্টের সবাইকেই টাকা দিয়ে দেয়, মোট ১,০০০ টাকা দেয়। কারণ ব্যাঙ্কের কাছে আরো টাকা আছে। সে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ছাপানো ভুয়া নোট ধার নিয়েছে। এছাড়াও আরো অনেক গ্রাহকের টাকা তার কাছে আছে। অতএব, সবমিলিয়ে তার দিতে কোনো অসুবিধা থাকে না।

আচ্ছা, নরমালি চিন্তা করেনতো, ব্যাঙ্ক যদি না থাকতো, তাহলে কি চালঅলা এসে আপনার কাছ থেকে ৯০ টাকা ঋণ পেত?
কিংবা ট্রাক্টরঅলা কি মুরগিঅলাকে ৮১ টাকা ঋণ দিত?
কিংবা কীটনাশকঅলা কি আলুঅলাকে ৭৩ টাকা ঋণ দিত?
নাহ। কখনোই না। নিজের কষ্টের জমানো টাকার ১০% রেখে বাকিটা ঋণ দিয়ে বেড়ানো -- এই কাজ আমরা কেউ জীবনেও করবো না। কিন্তু ব্যাংক আমাদের টাকা নিয়ে ঠিক এই কাজটাই করে। এইযে ব্যাঙ্কের কাছ থেকে চালঅলা, মুরগিঅলা আর আলুঅলা মিলে মোট ২৪৪ টাকা ধার নিলো, ব্যাংক না হলে তারা এটা পারতো না। ব্যাঙ্কের ঋণের কারণে মানুষের হাতে বেশি টাকা আসছে, যা স্বাভাবিকভাবে আসতো না।
আর মানুষের হাতে বেশি টাকা আসা মানে কী? মার্কেটে বেশি টাকা প্রবেশ করা।
মার্কেটে বেশি টাকা প্রবেশ করলে কী হয়?
মার্কেট sense করে ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। দ্রব্যমূল্য বাড়লেও আপনার তো বেতন বাড়ে না, তাই শেষমেষ পেটে লাথি পড়ে আপনার!
রিজার্ভ রেশিও
উপরে ৩য় লেনদেন এর ব্যাংকের হিসাব সেকশনটা দেখেন।
ব্যাংক ঋণ দিয়েছিল কত? ৯০+৮১+৭৩ = ২৪৪ টাকা।
আর তখন ব্যাঙ্কের কাছে জমা ছিল কত? ১০০+৯০+৮১ = ২৭১ টাকা।
তাহলে, ২৪৪ টাকা ঋণ (বা ক্রেডিট) সৃষ্টি করার মাধ্যমে সে মোট ২৭১ টাকা ডিপোজিট (জমা) তৈরী করতে পারলো।
তাহলে, ব্যাঙ্ক যত বেশি ঋণ দেবে, তত বেশি তার ব্যাঙ্কে ডিপোজিট তৈরী হবে, কেননা, যারা ঋণ নেবে, তারাও ঘুরেফিরে ব্যাঙ্কেই এসে টাকা রাখবে।
এভাবে, ১০% রিজার্ভ রেশিওতে ১০০ টাকাকে সর্বোচ্চ ১,০০০ টাকায় রূপান্তর করতে পারবে ব্যাঙ্ক (সর্বোচ্চ ৪৪ জনকে ঋণ দিয়ে, বা, মোট ৯০০ টাকা ক্রেডিট সৃষ্টি করে)।
রিজার্ভ রেশিও যদি ৫% হয়?
১০০ টাকাকে ২,০০০ টাকায় রূপান্তর করতে পারবে।
রিজার্ভ রেশিও যদি ৩% হয়?
কিংবা, ০% হয়?
বানিয়ে বলছি না, দুনিয়ার বহু ব্যাংকে অত্যন্ত কম রিজার্ভ রেশিও আছে। বাংলাদেশের বেসরকারী ব্যাঙ্কগুলোর রিজার্ভ রেশিও ৬.৫%।

এবার বুঝলেন, ব্যাঙ্কগুলো কেন এত যেচে যেচে ঋণ দিতে চায়? হোম লোন, কার লোন, এই লোন সেই লোন, লোন আর লোন। উদ্দেশ্য:
১. মার্কেটে বেশি টাকা সার্কুলেট করা (আর মার্কেটে বেশি টাকা মানেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি (পর্ব-১০ দেখুন) = আপনাকে শোষণ)
২. ইন্টারেস্ট (সুদ) পাাওয়া ( = ইন্টারেস্ট দিতে গিয়ে অধিক পরিশ্রম করতে হবে আপনাকে = শোষণ)
ব্যাঙ্কের মালিকদের নিজেদের পকেটের পয়সা দিয়ে কিন্তু তারা লোন দিচ্ছে না। দিচ্ছে বিভিন্ন ক্লায়েন্টের পয়সা থেকে, কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ছাপানো ভুয়া নোট ধার নিয়ে।
ক্রিপটোকারেন্সি/ বিটকয়েন যেটা করছে তা হলো, এরকম সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের বাইরে চলে এসেছে। ঋণ দেয়ানেয়া করলে 1 to 1 হবে। ফলে, ব্যাঙ্কের মত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক “মার্কেটে প্রচুর ক্যাশ প্রবেশ/ চালু করার” সুযোগ নাই। আর কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ইচ্ছামত ছাপানো ভুয়া নোট যে বেসরকারী ব্যাঙ্কের মাধ্যমে মার্কেটে প্রবেশ করবে -- সেটারও চান্স নাই।

অপরদিকে, সরকার কেন বড় বড় প্রজেক্ট হাতে নেয়?
১. প্রজেক্ট মানেই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের কাছ থেকে টাকা ধার নেয়া ( = কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক কর্তৃক অতিরিক্ত টাকা ছাপানো + সরকারের হাত দিয়ে মার্কেটে প্রবেশ করানো = দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে আপনাকে শোষণ)
২. ব্যাঙ্ককে সেই অতিরিক্ত ভুয়া নোটের ঋণ পরিশোধ করার জন্য সরকার কর্তৃক নিত্যনতুন ট্যাক্স আরোপ করা ( = আপনার ইনকামের একটা পার্সেন্টেজ সরকারকে দিয়ে দেয়া = একদিকে আপনার হাতের মোট অর্থ কমে যাওয়া, অপরদিকে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি = আপনাকে শোষণ)
মোটকথা,
• শূন্যের উপর টাকা তৈরী করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
• সরকার বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে সেই টাকা মার্কেটে প্রবেশ করায়।
• বেশি বেশি ঋণ দেবার মাধ্যমে বেসরকারী ব্যাংকও অতিরিক্ত টাকা মার্কেটে প্রবেশ করায়।
• অতিরিক্ত টাকা মার্কেটে ঢুকেছে - এটা sense করে ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়।
• পরদিন ঘুম থেকে উঠে আপনি গিয়ে দেখেন, পিঁয়াজের বাজারে আগুন!
• বেতনতো বাড়েনি, তাই পেটে লাথি পড়ে আপনার। ওভারটাইম কাজ করতে হয় আপনাকে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, মার্কেটে নোট বৃদ্ধি পাওয়া আমাদের প্রধান সমস্যা (পর্ব ১০)। আর এই কাজ "সরকারের প্রজেক্ট ব্যয়" ও "ব্যাঙ্কের টাকা ধার দেয়ার" মাধ্যমে ঘটে থাকে। সরকার করে deficit spending (যা আছে,  তার চেয়ে বেশি ব্যয় করা)। "ঘাটতি বাজেট" কথাটা শুনেছেন কখনো? এটাই হলো সেই ঘাটতি বাজেট। অর্থাৎ, আমার ঘাটতি/ কম আছে, কিন্তু আমি বাজেট/ বরাদ্দ করেছি অনেক বেশি টাকা। কিসের ভরসায়? কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ছাপানো ভুয়া নোটের ভরসায়।

অপরদিকে ব্যাঙ্ক প্রচুর মানুষকে ঋণ দেয়। মোটকথা, ব্যাঙ্ক ও সরকার দুইজনেই নিজেরা প্রচুর ঋণী হয়ে মার্কেটে অতিরিক্ত টাকা চালু করে দেয়। সাধারণ মানুষকেও লোনের উপর চলতে উদ্বুদ্ধ করে ও বাধ্য করে। আবার নিজেরাই নোট ছাপিয়ে নিজেদেরকে লোন দেয়, তারপর সেই ফাও নোটের জন্য জনগণকে খাটায় মারে। ট্যাক্স কাটে।

সংক্ষেপে, এমন শোষণমূলক অর্থনীতিকে বলে ক্রেডিট ড্রিভেন ইকোনমি (ঋণভিত্তিক অর্থনীতি)।
ইসলামী অর্থনীতি এর অনেকটাই বিপরীত। ইসলামী অর্থনীতি হলো প্রোডাকশন ড্রিভেন ও চ্যারিটি ড্রিভেন। মানুষ প্রোডিউস করার পরেই কেবল কনজিউম/ স্পেন্ড করবে। এবং স্পেন্ডিঙের আরেকটা খাত হবে চ্যারিটি (ফরজ, সুন্নাত ও মুস্তাহাব চ্যারিটি, পেনাল্টি চ্যারিটি ইত্যাদি)। এর ফলে ক্রেডিট ড্রিভেন ইকোনমির মত অতি দ্রুত গতিতে উন্নতি হয় না (at the expense of the labor of the working class), কিন্তু গণ অসন্তোষও থাকে না। মানুষের জীবনে স্বাভাবিকতা থাকে। ধর্মকর্ম করার সুযোগ থাকে। সেটা আরেকদিন আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

পর্ব-১৪: ঋণভিত্তিক ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের ভয়াবহতা: ভারতে হাজার হাজার কৃষকের আত্মহত্যা

যেই কৃষকের উৎপাদিত ধান-গমে গোটা জাতি প্রতিদিন বেঁচে থাকে, সেই কৃষক কেন আত্মহত্যা করে? বেকারত্ব? না। ডিপ্রেশান? না। লোনলিনেস? না। তাহলে? কখনো কি ভেবে দেখেছি? তাদের প্রতি কি কোনো দায়বদ্ধতাই নেই আমাদের?

২০১৪ সালে ইন্ডিয়াতে সাড়ে পাঁচ হাজার কৃষক আত্মহত্যা করে।
২০০৪ সালে ১৮ হাজার কৃষক আত্মহত্যা করে ইন্ডিয়াতে।
এবং প্রতিবছরই ভারতে কৃষক আত্মহত্যার রিপোর্ট আসছে।

কেন?

কারণটা বুঝতে পারবেন, যখন ভারত সরকারে "আত্মহত্যা রোধে গৃহীত পদক্ষেপ" জানতে পারবেন:
কৃষক আত্মহত্যা ঠেকাতে ভারত সরকার কোটি কোটি ডলারের ঋণ মওকুফ ঘোষণা করে ২০০৬ সালে (এবং একইসাথে আরো বেশি বেশি ঋণ দেয় কৃষকদেরকে, যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তী বছরগুলোতেও সুইসাইড বাড়তে থাকে! তখন আবারো ঋণ মওকুফ করে!! এবং আরো ঋণ দেয়!!)।

বাহ! যেই কৃষকেরা জমিতে ধান উৎপাদন করে, নিজের পেট চালায়, উপরন্তু অতিরিক্ত ধান-গম দিয়ে আমাদেরও পেট চালায়, সেই কৃষক ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করে!! সে এতই ঋণী!

হ্যাঁ! "কিষাণ ক্রেডিট কার্ড" এর সুফল! ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মহা জুলুম, মহা শোষণের একটা চিত্র ভারতের এই কৃষক আত্মহত্যা। যাদেরকে শয়তানি ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের ঋণের জালে জড়িয়ে আত্মহত্যায় বাধ্য করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে ৫৭% সুদের টাকা শোধ দিতে না পারায় যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো আপনারা জানেন। সেই সুদখোর মহাজন আজ শান্তিতে নোবেল বিজয়ী।

আমেরিকার সপ্তম প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসন ১৮৩০ সালে বলেছিলেন, "ব্যাংক আমাকে হত্যা করতে চায়, কিন্তু আমি ব্যাংককে হত্যা করব।"
এবং তিনি সেটা করেছিলেনও।

ব্যাংককে গোটা জাতির শত্রু হিসেবে ঘোষণা করার মত সেরকম সাহসী নেতা পরবর্তীতে আমেরিকায়ও কখনো হয়নি, আর সারা বিশ্বেও হয়নি। ১৯৬৩ সালে আমেরিকার ৩৫তম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কিছুটা চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তার কয়েক মাসের মাথায় তাকে আততায়ীর গুলিতে মৃত্যুবরণ করতে হয়।

 পর্ব-১৫: ক্রিপটোকারেন্সি/বিটকয়েন: ব্যাংক ছেড়ে প্রোগ্রামারদের উপর অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন
বিটকয়েন/ক্রিপ্টোকারেন্সি কথাটা অনেকেই শুনে থাকবেন। এ বিষয়ে একটু আলোচনা করি।
পর্ব-৯ এ পাঁচটি লেভেলে দ্রব্য বিনিময়ের কথা বলেছিলাম:
লেভেল-১: সরাসরি দ্রব্য বিনিময়
লেভেল-২: স্বর্ণমুদ্রার মাধ্যমে দ্রব্য বিনিময়
লেভেল-৩: কাগজের নোটের মাধ্যমে দ্রব্য বিনিময়, যার প্রতিটা নোটের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কে সমপরিমাণ গোল্ড আছে।
লেভেল-৪: লেভেল-৩ এর মতই, কিন্তু সমপরিমাণ গোল্ড রাখার কোনো বাধ্যবাধকতা নাই, সরকার ইচ্ছামত নোট ছাপে (আমরা বর্তমানে এই স্টেজে আছি)।
লেভেল-৫: ক্রিপ্টোকারেন্সি।
এবং দেখিয়েছিলাম যে, কেন আমাদেরকে লেভেল-২, অর্থাৎ স্বর্নমুদ্রাই ব্যবহার করতে হবে। যাহোক, উপরের ৫টা লেভেলের তুলনামূলক পার্থক্য দেখলেই আমরা বুঝতে পারব, ক্রিপ্টোকারেন্সির অবস্থানটা কোথায়।
লেভেল-১: সরাসরি দ্রব্য বিনিময়।
সরকারী নিয়ন্ত্রণ: নাই।
লেনদেনের দলিল: থাকে না।
আস্থা: কোনোকিছুর উপর আস্থা রাখতে হয় না। সরাসরি দ্রব্য বিনিময়।

লেভেল-২: স্বর্ণমুদ্রার মাধ্যমে দ্রব্য বিনিময়।
লেনদেনের দলিল: থাকে না সাধারণত, যদি না আলাদা কাগজে কেউ লিখে রাখে।
আস্থা: স্বর্ণমুদ্রার উপর কিছুটা আস্থা তো রাখতেই হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহার করে কিছু না কিনছি, ততক্ষণ একটা টেনশান থেকেই যায়: আগামীকাল যদি দাম বেড়ে যায়? তবে, একটা ভরসা থাকে যে, গোল্ড তো গোল্ড-ই। দুনিয়ার যেখানেই যাই, এটা ব্যবহার করে জিনিস কিনতে পারব।
সরকারী নিয়ন্ত্রণ: থাকতেও পারে, না-ও পারে। ধরেন, সবজায়গায় মানুষ স্বর্ণমুদ্রায় লেনদেন করে। এখন, একটা সরকার প্রতিষ্ঠা হলো। সরকার জনগণের থেকে ট্যাক্স নেয়া শুরু করলো। ট্যাক্সের গোল্ডকয়েনগুলো ব্যাঙ্কের ভল্টে রাখলো। এছাড়াও, সবার স্বর্ণমুদ্রায় দেশের প্রতীকের ছাপ দিয়ে দিল। তবে --
সরকার ঘোষণা দিয়ে নোট বাতিলের মত স্বর্ণকে বাতিল করতে পারে না। তাই, স্বর্ণমুদ্রায় দেশের ছাপ থাকুক বা না থাকুক, দুনিয়ার যেকোনো জায়গায় স্বর্ণমুদ্রাটা চলবে। ব্যাংক/সরকারের কন্ট্রোল খুবই কম এখানে। তবে --
সরকার ট্যাক্স হিসেবে যেসব গোল্ডকয়েন নিয়েছে জনগণের কাছ থেকে, সেসব গোল্ডে ভেজাল মিশিয়ে চাইলে একইরকম দেখতে বেশি বেশি গোল্ডকয়েন তৈরী করতে পারে। এভাবে করে মার্কেটে "more money in circulation" তৈরী করতে পারে, ফলশ্রুতিতে ইনফ্লেশান ঘটবে। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাবে। তবে --
যেহেতু গোল্ডে খুব বেশি ভেজাল দিলে সেটা মানুষের চোখে ধরা পড়ে যাবে, সেহেতু খুব বেশি ইনফ্লেশান হবার চান্স নেই (অন্ততঃ জার্মানির মত তো হবে না যে, ১৪৪টা প্রিন্টিং প্রেস দিনরাত নোট ছাপতে ছাপতে কাগজ ফুরিয়ে ফেলেছিলো!)।
ইতিহাসে এথেন্সের সরকার এই কাজ করেছিলো যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে গিয়ে।
(তো, দেখা যাচ্ছে, স্বর্ণমুদ্রাও ১০০% পারফেক্ট সমাধান নয়!)
(পৃথিবীর যত কয়েন আছে, এগুলো কেন সোনালী বা রূপালী রঙের হয়, এবার বুঝেছেন? ভিতরে লোহা হলেও উপরে অন্য জিনিসের প্রলেপ দিয়ে দেখতে সোনার মত করা হয় কিংবা রূপার মত করা হয় কেন? একদম প্রথম পোস্ট কিন্তু এটা নিয়েই দিয়েছিলাম।)

লেভেল-৩: কাগজের নোটের মাধ্যমে দ্রব্য বিনিময়, যার প্রতিটা নোটের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কে সমপরিমাণ গোল্ড আছে।
আস্থা: পুরোপুরি সরকারের উপর আস্থা রাখতে হয়। অর্থাৎ, কাগজের উপর আস্থা রাখতে হয়। গোল্ডের যেমন নিজস্ব মূল্য ছিল, কাগজের তেমন নিজস্ব কোনো মূল্য নেই।
সরকারী নিয়ন্ত্রণ: ১০০%। সরকার কাগজের নোট বাতিল ঘোষণা করলেই সাথে সাথে বাতিল। আবার, সরকার নতুন নোট চালু করলে জনগণ সেটা ব্যবহার করতে বাধ্য। আবার, সরকার যদি মুখে বলে যে গোল্ডের সমপরিমাণ নোট প্রিন্ট করেছি, কিন্তু বাস্তবে আরো বেশি প্রিন্ট করে, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চেক করার কোনো সুযোগ জনগণের নাই। ইতিহাসে ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের ভাঁওতাবাজি এভাবেই শুরু হয়েছিলো (পর্ব-৮ দেখুন)। এছাড়াও, গোল্ডের বিপরীতে এই নোট ছাপতে খরচ আছে, এবং নোট নষ্ট হয়ে গেলে আবারও নতুন নোট ছাপতে হবে। এতে প্রচুর খরচ হয়।
লেনদেনের দলিল: মানুষজন রাখতেও পারে, না-ও পারে। তবে বড় বড় লেনদেন, যেগুলো ব্যাংক এর মাধ্যমে হয়ে থাকে, সেগুলোর দলিল ব্যাঙ্কে থেকে যায়।

লেভেল-৪: উপরের মতই, জাস্ট গোল্ড ব্যাকিং নেই। অতএব, প্রচুর ইনফ্লেশান ঘটার রিস্ক থাকে। আসলে লেভেল-৩ ও লেভেল-৪ প্রায় একই রকম। কারণ, লেভেল-৩ টা জাস্ট সরকারের ওয়াদার উপর ভিত্তি করে যে: আমরা গোল্ডকয়েনের চেয়ে বেশি নোট ছাপাবো না। কিন্তু যেহেতু এটা চেক করার কোনো উপায় সাধারণ মানুষের নাই, তাই এই আস্থা তারা ভঙ্গ করবেই (পর্ব-৩ এ মার্কেটে টাকার আগমন পর্বে বলেছিলাম, টাকার উপর এই "আস্থা" শব্দটা খুউব ভালো করে লক্ষ্য করবেন)। ফলশ্রুতিতে আমরা লেভেল-৪ এ এসে উপনীত হবো, যেখানে সরকার তার ইচ্ছামত নোট ছাপিয়ে মুদ্রাস্ফীতি ঘটায়, এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে জনগণের নাভিশ্বাস ওঠে।
লেনদেনের দলিল: বর্তমান সময়ে ছোটখাটো বেশিরভাগ লেনদেনেই রিসিট আদান-প্রদান হয়, কিংবা বিভিন্ন কম্পিউটারে সেই তথ্য সংরক্ষিত থাকে। আবার, যখন আমরা সরাসরি কার্ড ব্যবহার করে কেনাকাটা করি, তখন কিন্তু হাতে কাগজের নোট লেনদেন করতে হয় না -- ব্যাঙ্কের কম্পিউটারের হিসাব থেকে আমার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কেটে নেয় -- সবই সফটওয়্যারে হয়।

লেভেল-৫: ক্রিপ্টোকারেন্সি/ বিটকয়েন।
সরকারী নিয়ন্ত্রণ: নাই।
লেনদেনের দলিল: ১০০% আছে। ইন ফ্যাক্ট, লেনদেনের দলিল না থাকলে লেনদেনই হবে না। মূলতঃ, সিস্টেমটাই দলিল ভিত্তিক।
ভেজাল তৈরী সম্ভব?
উত্তর: খুব একটা না। উচ্চস্তরের সফটওয়্যার এঞ্জিনিয়ার/ কম্পিউটার প্রোগ্রামার/ হ্যাকার ছাড়া ক্রিপ্টোকারেন্সিকে ম্যানিপুলেট করে নিজেকে বড়লোক বানিয়ে নিতে পারবে না।
আস্থা: ব্যাংক/ সরকারের উপর আস্থা রাখতে হয় না বটে, কিন্তু শতভাগ অন্ধভাবে প্রোগ্রামারদের উপর আস্থা রাখতে হয়।

সিস্টেমটা কিভাবে কাজ করে?
ধরেন, সবাই দ্রব্য বিনিময় করে। চালঅলা আর ডালঅলা দুইজন আছে শুধু। সেই প্রথম উদাহরণের মত।
এখন মালঅলা এসে ওদের মাঝে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিটকয়েন চালু করবে, যেভাবে করে কাগজের টাকা চালু করেছিলো।
সে এসে দুইজনের হাতেই দুইটা স্মার্টফোন দিলো। প্রত্যেকের স্মার্টফোনে বিটকয়েন অ্যাপ ইনস্টল করা আছে। চালঅলার ব্যালেন্স আছে ১০ বিটকয়েন। ডালঅলার ব্যালেন্স ০ বিটকয়েন।
এখন বললো, তোমরা লেনদেন করো এইভাবে:
১ কেজি ডাল = ১ বিটকয়েন।
চালঅলা ২ কেজি ডাল কিনলো। তার অ্যাকাউন্টে ছিলো - ১০ বিটকয়েন, ডালঅলার অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করলো - ২ বিটকয়েন।
চালঅলা আর ডালঅলা দুইজনেরই স্মার্টফোনে বিটকয়েন অ্যাপে লেখা উঠলো:
লেনদেন: from চালঅলা to ডালঅলা। অ্যামাউন্ট: ২ বিটকয়েন। তারিখ: ৫ই জানুয়ারি, ২০১৪। দ্রব্য: দুইকেজি ডাল।
আচ্ছা, এবার মনে করেন মুরগিঅলা এলো। মালঅলা তাকেও একটা স্মার্টফোন দিলো। সেটাতে বিটকয়েন অ্যাপ আছে। আর তার ব্যালেন্স ০ বিটকয়েন।
মুরগিঅলা বিটকয়েন অ্যাপ ওপেন করেই দেখলো সেখানে লেখা:
লেনদেন: from চালঅলা to ডালঅলা। অ্যামাউন্ট: ২ বিটকয়েন। তারিখ: ৫ই জানুয়ারি, ২০১৪। দ্রব্য: দুইকেজি ডাল।
এবার চালঅলা একটা মুরগি কিনবে। সে ১ বিটকয়েন ট্রান্সফার করে দিলো মুরগিঅলার অ্যাকাউন্টে।
সাথে সাথে চাল, ডাল, মুরগিঅলা - তিনজনেরই স্মার্টফোনে বিটকয়েন অ্যাপে লেখা উঠলো:
লেনদেন: from চালঅলা to মুরগিঅলা। অ্যামাউন্ট: ১ বিটকয়েন। তারিখ: ৫ই জানুয়ারি, ২০১৪। দ্রব্য: একটি মুরগি।
এবার আলুঅলা এলো। মুরগিঅলা ১ বিটকয়েন দিয়ে দশকেজি আলু কিনলো। সাথে সাথে চাল, ডাল, মুরগি ও আলুঅলা, চারজনেরই স্মার্টফোনে লেখা উঠলো:
লেনদেন: from মুরগিঅলা to আলুঅলা। অ্যামাউন্ট: ১ বিটকয়েন। তারিখ: ৫ই জানুয়ারি, ২০১৪। দ্রব্য: দশকেজি আলু।

তারপর মার্কেটে আরো দশজন ক্রেতাবিক্রেতা এলো। কিংবা একশো। কিংবা এক কোটি।
যে কোনো দুইজন ব্যক্তি যখন কোনো লেনদেন করে, সাথে সাথে সবার স্মার্টফোনে সেটার হিসাবের একটা করে কপি তৈরী হয়ে যায়। চিন্তা করতে পারেন! আপনি কারো অ্যাকাউন্টে টাকা (বা বিটকয়েন) ট্রান্সফার করলেই সাথে সাথে সেই লেনদেনের তথ্য (ট্রানজেকশন হিস্ট্রি) কোটি কোটি স্মার্টফোনে চলে যাচ্ছে! অবৈধ ড্রাগসের ব্যবসা করবেন? গোপনে লেনদেন করবেন?
সম্ভবই না!
কিংবা গোল্ডকয়েন চুরি করবেন? কিংবা জালনোট তৈরী করবেন? তা হয়ত করতে পারবেন। কিন্তু সফটওয়্যার হ্যাকিং করে নিজের অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স বাড়িয়ে নেবেন? (অনেকটাই) অসম্ভব, কারণ হাই লেভেল ক্রিপ্ট্রোগ্রাফি ব্যবহার করে সেটাকে সিকিউর করা হয়েছে। আর যদিওবা নিজের ফোনে হ্যাকিং করেন, অন্য কোটি কোটি ইউজারের ফোনের সফটওয়্যার সেই গরমিল ধরে ফেলবে।
এখন, ক্রিপ্টোগ্রাফি বললে কি আপনি বুঝবেন? আমি প্রোগ্রামার, আমি নাহয় বুঝি। আপনি তো বুঝবেন না। পৃথিবীর সব মানুষ তো বুঝবে না। কিন্তু হাতে যখন সলিড গোল্ড এনে দেবেন, দুনিয়ার যেকোনো মানুষই সেটা ধরে চিনবে, বুঝবে। আস্থা রাখতে পারবে।
অতএব, ক্রিপ্টোগ্রাফি কী, সেই বিস্তারিত ব্যাখ্যায় গেলাম না। মূল কনসেপ্টটা শুধু ব্যাখ্যা করলাম।
প্রচলিত ব্যাঙ্কিং সিস্টেমকে আমরা শয়তানের মহাযন্ত্র মনে করি এই কারণে যে, তাদের উপর আমাদের আস্থা রাখতে হয়, আর এই আস্থার সুযোগ নিয়ে তারা ইচ্ছামত হিসাবে গরমিল করে, নোট ছাপায় এবং আমাদেরকে শোষণ করে।
আর সেই ব্যাঙ্কিং থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে আরো বেশি অন্ধ আস্থা স্থাপন করব প্রোগ্রামারদের উপর?
No way. সম্ভব না। কখনোই না। Give me solid gold, baby. I will be happy.

পর্ব-১৬: Fractional reserve banking কেন গ্রহণযোগ্য নয়, এবং মুদ্রাস্ফীতি ঠেকানোর উপায়: lock-in banking
Fractional reserve banking কেন গ্রহণযোগ্য নয়?
"ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যাংকিং" - এই শব্দ দেখে ঘাবড়াবেন না। এইসব মহা মহা গালভারী শব্দ অর্থনীতির লোকেরা ব্যবহার করে যেন আমরা তাদের জোচ্চুরি ধাপ্পাবাজি শয়তানি বুঝতে না পারি। বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো আরকি। এমনকি ইংলিশভাষীরাও বোঝে না। কিন্তু আমি সহজ বাংলায় বুঝিয়ে বলব।
ব্যাংক মানে কী? ঐযে, আলাদিনের চেরাগের মত দেখতে মাটির একটা জিনিস, যেটাতে আমরা ছোটবেলায় পয়সা রাখতাম। অর্থাৎ, টাকা জমা রাখার জিনিস।
রিজার্ভ কী? ঐযে, ঐ মাটির ব্যাংক এর মধ্যে আমরা যেটা জমা রাখি, সেটা।
full reserve - ফুল রিজার্ভ - মানে যা ব্যাঙ্কে রেখেছি, তার পুরোটাই ব্যাঙ্কে জমা আছে।
fractional reserve - ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ - মানে যা ব্যাঙ্কে রেখেছিলাম, তার ভগ্নাংশ বা একটা ফ্র্যাকশন জমা আছে মাত্র, বাকীটা ব্যাংক ঋণ দিয়েছে কাউকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন অনুযায়ী বেসরকারী ব্যাংকগুলো ৬.৫% টাকা রেখে বাকী টাকা ঋণ দিতে পারবে। মানে, fractional reserve ratio হলো 6.5%। অর্থাৎ, আপনি ১০০ টাকা জমা রাখলে ব্যাংক সাড়ে ছয় টাকা নিজের কাছে রেখে বাকিটা ঋণ দিতে পারবে।

কেন এটা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর? সেটা আমরা পর্ব ১৩ তে আলোচনা করেছিলাম। সেখানে দেখিয়েছিলাম যে, ১০% রিজার্ভ রেশিওতে ১০০ টাকা কিভাবে ১,০০০ টাকায় রুপান্তরিত হয় (মনে না থাকলে পর্ব ১৩ আবার পড়ে নিন)।
তবু আবারো বলছি।
ধরেন, আপনার ১০০ টাকা আছে। আপনি তা থেকে ৯০ টাকা কাউকে ধার দিলেন।
আপনার ছিল - ১০০
ধার দিলেন - ৯০
_____________
এখন আছে - ১০
তো, ঐ লোক মার্কেটে গেল (৯০ টাকা নিয়ে), আপনিও মার্কেটে গেলেন কিছু কিনতে (১০ টাকা নিয়ে)। ঐ লোকের ক্রয়ক্ষমতা (purchasing power) বেড়ে গেল (৯০ টাকা বাড়লো)। আর আপনার ক্রয়ক্ষমতা ঠিক ততটুকুই কমে গেল (১০ টাকা হয়ে গেল)। মোট টাকা কিন্তু মার্কেটে ১০০।
কিন্তু এই ১০০ টাকাই যদি আপনি ব্যাংকে রাখতেন? ব্যাংক তা থেকে ৯০ টাকা কাউকে ধার দিলো। পরদিন আপনি যখন ব্যাংকে গিয়ে আপনার টাকাটা তুলবেন, ব্যাংক কিন্তু বলে না যে, "স্যরি ভাই, তোমার টাকা থেকে ৯০ টাকা তো আমি একজনকে একটু ধার দিয়েছি, আপাততঃ এই নাও ১০ টাকা, বাকী ৯০ টাকা পরে দেব। ঐ লোক ফেরত দিলে দেব।"
ব্যাংক কী করে? আপনাকে ১০০ টাকাই দিয়ে দেয়।
আর ওদিকে ঐ লোককে কিন্তু দিয়েছে ৯০ টাকা।
পরদিন আপনারা দুইজনই বাজারে যান। বাজারে মোট টাকা কত? ১৯০ টাকা। এইযে আর্টিফিশিয়ালি টাকার পরিমাণ বেড়ে গেল মার্কেটে, আর আমরা জানি যে, মার্কেটে টাকার পরিমাণ বাড়লে দ্রব্যমূল্য বাড়ে (মানি মেকানিজম পর্ব ১০)।
লাভবান হয় তারা, যারা দ্রব্যমূল্য বাড়ার আগেই কেনাকাটা করে (তাদের হাতে new money: extra cash আসার কারণে)।
আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারা? যারা দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাবার পরে মার্কেটে যায়, অথচ তাদের হাতে অতিরিক্ত ক্যাশও আসেনি।
তাহলে, মার্কেটে অধিক পরিমাণে টাকা প্রবেশ করে fractional reserve banking এর কারণে। মার্কেটে অধিক পরিমাণে টাকা প্রবেশের এই ব্যাপারটাকে বলে মুদ্রাস্ফীতি বা inflation. মুদ্রাস্ফীতি ঘটলে দ্রব্যমূল্য বাড়ে। উচ্চ দ্রব্যমূল্যের দ্বারা সাধারণ মানুষ জুলুমের শিকার হয়।
অর্থাৎ, ব্যাংক আরেকজনের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে (যে ৯০ টাকা ঋণ নিলো ব্যাংক থেকে, তার ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলো),
কিন্তু যেই আমার টাকা ধার দেয়ার মাধ্যমে ঐ লোকের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে, সেই আমার ক্রয়ক্ষমতা কিন্তু কমালো না (আমি চাওয়ামাত্রই আমাকে ১০০ টাকা দিয়ে দিলো) !
ফলশ্রুতিতে আমিও খুশিমনে ১০০ টাকা নিয়ে মার্কেটে যাই, ঐ লোকও ৯০ টাকা নিয়ে খুশিমনে মার্কেটে যায় -- জনগণ খুশি খুশি, ওদিকে মার্কেটে বেশি টাকা প্রবেশের কারণে দুইদিন পর উচ্চ দ্রব্যমূল্যে নাভিশ্বাস!

সমাধান: তাহলে কি ব্যাংকিং বন্ধ? না। আমাদের কথা হচ্ছে যে, ব্যাংক যখন আমার টাকা অন্যকে ধার দিয়ে অন্যের ক্রয়ক্ষমতা (purchasing power) বৃদ্ধি করবে, তখন আমার ক্রয়ক্ষমতা ঠিক ততটুকুই কমিয়ে দেবে (restrict করবে)।
ধরেন, আপনি ব্যাংকে ১০০ টাকাই রাখলেন। কিন্তু ব্যাংকের সাথে চুক্তি হবে এভাবে:
"এই ১০০ টাকা আমি তিন বছর পর ফেরত নেব। এই ৩ বছরে ব্যাংক এই টাকা বিভিন্ন জায়গায় ধার দিয়ে/ ব্যবসায় খাটিয়ে মুনাফা/ প্রফিট করবে। তারপর ৩ বছর পর ১০০ টাকা ফেরত দেবে + প্রফিটের x% দেবে।"
আর আমার জমা রাখা টাকাটা ব্যাংক যাকে ঋণ দেবে, তার সাথেও একইভাবে চুক্তি হবে:
"৩ বছর পর এই ১০০ টাকা ব্যাংককে ফেরত দিতে হবে + এই টাকা খাটিয়ে যে লাভ হবে, তার একটা পার্সেন্টেজ দিতে হবে ব্যাংককে।"
তাহলে কী হলো? এই ১০০ টাকা হাতে নিয়ে ঐ লোক মার্কেটে গেল। আপনি গেলেন ০ টাকা হাতে নিয়ে। মোট টাকার পরিমাণ আগের মতই থেকে গেল। দ্রব্যমূল্যও বাড়লো না। মুদ্রাস্ফীতিও হলো না। All is well.

(প্রসঙ্গতঃ, সিমিলার সিস্টেম বাংলাদেশের মরহুম অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান করেছিলেন শেয়ার মার্কেটের ক্ষেত্রে। লক-ইন সিস্টেম চালু করেছিলেন, যার ফলে শেয়ার একটা কিনলে মিনিমাম ২/৩ বছরের আগে তা বিক্রি করতে পারবে না -- এরকম শর্ত ছিল। ফলশ্রুতিতে শেয়ার বাজার স্থিতিশীল হয়েছিল অনেকটা।)
তো, ব্যাংকগুলোকে Fractional reserve এর এই আর্টিফিশিয়াল আনন্যাচারাল সিস্টেম বন্ধ করতে হবে। এতে মুদ্রাস্ফীতিও ঠেকবে, মানুষও বাঁচবে। তার পরিবর্তে lock-in banking চালু করতে হবে।
আর... এই পদ্ধতির সাথে ইসলামের সম্পর্ক কী? সেটা নাহয় ইসলামী অর্থনীতির আলোচনায় বলব।

পর্ব-১৭: আমেরিকার কাছ থেকে গোল্ড ফেরত নিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন দেশ
২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ টন গোল্ড কিনেছে।
২০০৯ সালে ইন্ডিয়াও IMF এর কাছ থেকে গোল্ড কিনেছে। কত? ২০০ টন।
২০১১ সালে মেক্সিকো সরকার কিনেছে ১০০ টন।
২০১৪-১৫-১৬ সালে জার্মানি যথাক্রমে ১২০, ২১০ ও ২০০ টন গোল্ড দেশে ফিরিয়ে নিয়েছে (আমেরিকা ও ফ্রান্সের কাছ থেকে ফেরত নিয়েছে)।
২০১৪ সালে আমেরিকার কাছ থেকে ১২২ টন গোল্ড ফেরত নিয়েছে নেদারল্যান্ডস।
২০১২ সালে ভেনিজুয়েলার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হিউগো শ্যাভেজ মোট ১৬০ টন গোল্ড ফেরত নিয়েছে তার দেশে (আমেরিকা, ক্যানাডা ও ইউরোপ থেকে)।
রাশিয়া এবং চায়না শত শত টন গোল্ড কিনছে।

আর বেশি স্ট্যাটিস্টিকস দেবো না, মূল কথায় আসি।
কথা হলো, ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে সারা দুনিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলো পাগলের মত গোল্ড কেনা শুরু করেছে। বিশেষতঃ, আমেরিকার ফেডেরাল রিজার্ভ ব্যাংক এর ভল্টে রাখা গোল্ডগুলো ফেরত নিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন দেশ।
অর্থাৎ: "তোমার কাগজের নোট (ডলার) নাও, আর আমাকে গোল্ড দাও।" কেউ-ই কাগজের ডলার হাতে রাখতে চাইছে না। কোনো দেশই না। সবাই যেন স্বর্ণমুদ্রার যুগে ফিরে যেতে চাইছে।
কেন? সারা দুনিয়ার সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কগুলো কি বিশ্বব্যাপী মহা অর্থনৈতিক ধ্বস/ মন্দা আঁচ করতে পেরেছে তারমানে?
আমার মনে আছে, ২০১১ সালে কম্পিউটার সায়েন্সে ব্যাচেলরস ভর্তি হই, তখন বাংলাদেশ আর্মির সাবেক ক্যাপ্টেন, ডিপার্টমেন্ট হেড সাজ্জাদ স্যার আমাদেরকে প্রোগ্রাম করতে দিয়ে বলতেন, "আপনারা এক্সাম দেন, আমি একটু পিছনের  কম্পিউটারে বসে দেখি, কোন দেশের গোল্ড রিজার্ভ কত বাড়লো।"
আমরা হাসতাম। ভাবতাম, মাথায় সমস্যা আছে।
এখন নিজেকে নিয়ে হাসি। ভাবি, আমার মাথা-ই ছিল না এতদিন!

পর্ব-১৮: ইসলামী অর্থনীতি বনাম ঋণভিত্তিক অর্থনীতি ১/৩
কোনো জাতির অধিকার নেই, তাদের ভবিষ্যত জেনারেশানের ভাগ্য নির্ধারণ করার।
মনে করেন, আমরা বাংলাদেশীরা একজন রাজাকে মেনে নিলাম। কিন্তু ঐ রাজার ছেলে আমাদের সন্তানদের রাজা হবে, তারপর নেক্সট জেনারেশানের রাজা হবে সেই রাজপুত্রের ছেলে -- এভাবে বংশ পরম্পরায় রাজার বংশধরেরা আমাদের পরবর্তী সকল জেনারেশানকে শাসন করতে থাকবে -- এইটা নির্ধারণ করার অধিকার আমাদের নাই। যদি আমরা তা করি, তাহলে সেটা হবে ভবিষ্যত জেনারেশানের উপর জুলুম।
ঠিক তেমনি কোনো বাপের অধিকার নেই যে, সে দুই দশ কোটি টাকা ধার করবে এই শর্তে যে, তার ছেলে ঐ টাকা শোধ করবে! তারপর সে ঐ কোটি কোটি টাকা ভোগ করবে, আর তার মরার পরে তার ছেলে সারাজীবন খেটে ঐ ঋণ শোধ করবে!

ইসলামের আইন কী বলে?
১. আপনি যখন ঋণ করবেন, তখন চুক্তিপত্র তৈরী করবেন।
২. আপনি মারা গেলে আপনার রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে আপনার সকল অপরিশোধিত ঋণ পরিশোধ করা হবে।
৩. তারপর আপনার কোনো ওছিয়ত থাকলে সেটা দিয়ে দেওয়া হবে।
৪. সবশেষে উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী আপনার অবশিষ্ট সম্পদ বন্টন হবে।

কিন্তু যদি, মনে করেন, আপনি দশ কোটি টাকা ঋণ করেছিলেন। আপনি মারা গেলেন দুই কোটি টাকার সম্পদ রেখে। তখন কী হবে?
আপনার সন্তান কি বাকী আট কোটি টাকা শোধ করবে?
না।
এটা সন্তানের উপর জুলুম হবে। এটা বিবেকবিরোধী কাজ। ইসলাম এটা সমর্থন করে না। কোনো মানুষের অধিকার নেই অপরের পায়ে বন্দীত্বের শেকল জড়ানোর।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা ইসলামী অর্থনীতির একটি স্তম্ভ বা পিলার বা মূলনীতি শিখে ফেলেছি। এবং সেটা শিখেছি অর্থনীতির জটিল শব্দ ব্যবহার ছাড়াই। এখন যখন ঐসব দুই-একটা শব্দ ব্যবহার করব, তখন আর বুঝতে অসুবিধা হবে না। যেমন - ক্রেডিট।
অর্থনীতির ভাষায় ক্রেডিট (credit) মানে হলো ঋণ।
ঋণ কী?
ঋণ অর্থ হলো: "আমি আজকে যতটুকু শ্রম দিচ্ছি, তার চেয়ে বেশি ভোগ করছি। আগামীকাল আমি পরিশ্রম করব বেশি, ভোগ করব কম, উদ্বৃত্ত অংশটুকু দিয়ে ঋণ পরিশোধ করব।"
যেমন, ধরেন আমি প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা মাটি কাটি। দিনশেষে ৩ টাকা মজুরি পাই। মাসে মোট ৯০ টাকা। ৩০ দিনে ৩ বেলা ভাত = ৯০ বেলা ভাত। প্রতিবেলায় ১ টাকার ভাত খাই।
• পর্যবেক্ষণ: যা পরিশ্রম করি, তা-ই ভোগ করি। পরিশ্রম = ভোগ।

এখন, আপনার কাছ থেকে ১০ টাকা ঋণ নিলাম। মাসের দশদিন আমি তিনবেলা খাওয়ার পাশাপাশি আরো এক বেলা করে বেশি খেলাম (বিরিয়ানি খেলাম)।
• পর্যবেক্ষণ: যা পরিশ্রম করেছি, তার চেয়ে বেশি ভোগ করেছি। ভোগ > পরিশ্রম।

পরের মাসে কী হবে? যখন ঐ দশ টাকা শোধ করতে হবে?
তখন কিন্তু দশদিন আমাকে দুইবেলা করে খেতে হবে। এভাবে দশটাকা জমিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
• পর্যবেক্ষণ: যা পরিশ্রম করব, তার চেয়ে কম ভোগ করব। ভোগ < পরিশ্রম।
তাহলে, ঠিক যতটুকু ঋণ নিলাম আজকে, কালকে ঠিক ততটুকু কম ভোগ করব। এভাবে ঋণ পরিশোধ করব।

পাঠক, বিরক্ত হবেন না আশা করি যে, এত সহজ জিনিস কেন বুঝালাম এত সময় ধরে! কারণ আমরা ব্যক্তি পর্যায়ের ঋণ বুঝি, এবং এটাও বুঝি যে, একমাসে বেশি ঋণ করে ফেললে পরের মাসে "একটু চেপে চলতে হবে", মাছ-মুরগি একটু কম খেতে হবে, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ের ঋণ বুঝি না। Credit-driven economy বুঝি না। আর সেটা বুঝতে হলে ব্যক্তি পর্যায়ের ঋণ খুব ভালো করে বোঝা দরকার।

উপরের দুইটা আলোচনা থেকে আমরা এটা বুঝলাম যে:
• একজনের ঋণের বোঝা আরেকজনকে বহন করতে হবে -- এমন কৌশল করা এক মহা জুলুম।
• ঋণ অবশ্যই ব্যক্তি পর্যায়ের মাঝে সীমিত হতে হবে (1 to 1)।
• এমন পরিমাণে ঋণ করা উচিত নয় যে, যা শোধ দিতে গেলে সারামাস না খেয়ে চলতে হবে। কেননা, এমন ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা আর ঋণ পরিশোধ করে না, এবং ঋণদাতা ব্যক্তি টাকা ফেরত না পেয়ে জুলুমের শিকার হয়।
• ঋণ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত।
কিন্তু আমাদের সমাজে কী হচ্ছে? সমাজে না, দেশে। শুধু আমাদের দেশে না, দুনিয়ার সব দেশেই। কী হচ্ছে? "সরকার" ঋণ করছে।
যেখানে সরকারের কাজের পদ্ধতি হওয়া উচিত ছিল এমন:
জনগণ প্রত্যেকে ১টা করে গোল্ডকয়েন দিলো। ১৬ কোটি গোল্ডকয়েন হাতে পাওয়ার পর সরকার একটা ব্রিজ বানালো।
কিন্তু সেখানে সরকার কী করছে? বিদেশ থেকে ঋণ নিচ্ছে। ব্যাংক এর কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে। কিন্তু সেটা কি সরকারের ৩০০ জন এমপি নিজে নিচ্ছে? এবং তারা নিজে পরিশোধ করছে? না। তারা ঋণ নিচ্ছে ১৬ কোটি জনগণের জন্য। ১৬ কোটি জনগণের উপর ঋণ চেপে বসছে। অথচ তাদেরকে আমরা এইজন্য ক্ষমতায় বসাইনি যে, তারা আমাদের এবং আমাদের ফিউচার জেনারেশানের উপর ঋণ চাপিয়ে দেবে। আর--
• আমরা জানি যে, আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ক্রেডিট বা ঋণ তৈরী করার মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা তৈরী করা হয় (পর্ব ১৩ দেখুন)।
• মার্কেটে অতিরিক্ত টাকা প্রবেশ করলে বা মুদ্রাস্ফীতি (inflation) ঘটলে দ্রব্যমূল্য বাড়ে (পর্ব ১০ দেখুন)।
• দ্রব্যমূল্য বাড়লে সিংহভাগ জনগণের পেটে লাথি পড়ে, কেননা দ্রব্যমূল্য দৌড়ায় খরগোশের গতিতে, আর বেতন বাড়ে কচ্ছপের গতিতে।
• ফিউচার জেনারেশান এমন একটি পরিবেশে জন্ম নেয় যে, তাকে অবশ্যই "পদ্মাসেতুর ঋণ" পরিশোধ করতে হয় (চিপস কিনলে ভ্যাট, সিগারেটের উপর ট্যাক্স, ফোনে কথা বললে ট্যাক্স, ভার্সিটিতে ৭% ট্যাক্স, ইত্যাদির মাধ্যমে)।
• আর ভ্যাট / ট্যাক্স দেয়া মানেই হলো, আমি যা পরিশ্রম করছি, তার চেয়ে কম ভোগ করছি। কেন? কারণ আমার পূর্বপুরুষ "পদ্মাসেতুর টাকা" ভোগ করেছে, আর সেটার ঋণ শোধ করছি আমি।

ধরেন, সরকার যদি ঋণ না নিয়ে পদ্মাসেতু করতে চাইতো? তাহলে আরো দশ বছর ধরে দেশের জনগণকে অনেক পরিশ্রম করে টাকা জমাতে হত। তারপর সরকারের হাতে দিলে সরকার ব্রিজ বানাতে পারতো। তাই না?
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে:
"সরকার ঋণ নিলে একটা দেশের ডেভেলপমেন্ট দ্রুত হয়।"
অর্থাৎ, ক্রেডিট-ড্রিভেন ইকোনমি বা ঋণভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় দ্রুত উন্নতি হয়।
কিন্তু আমরা আজকে আলোচনা করলাম যে, ঋণ ব্যক্তিপর্যায়ে হওয়া উচিত, জাতীয় পর্যায়ে নয়। কেননা, জাতীয় পর্যায়ের ঋণ বা সরকারের ঋণের বোঝাগুলো ফিউচার জেনারেশানকে স্লো পয়জনিঙের মত ট্যাক্স এর মাধ্যমে বহন করতে হয়। এটা এক মহা জুলুম। জাতীয় শোষণ।

এ পর্ব আর বড় করব না। আপাততঃ এতটুকু বোঝা দরকার যে:
• সরকার ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করে, এবং দেশী-বিদেশী ঋণের মাধ্যমে গোটা জাতিকে ঋণগ্রস্ত করে।
• ফিউচার জেনারেশান পদ্মাসেতুর ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে জন্ম নেয়, যেকারণে তাকে টিউশন ফির উপর ৭% অতিরিক্ত ভ্যাট দিয়ে সে ঋণ শোধ করতে হয়।
• এই স্লো-পয়জনিং সিস্টেমে মানুষকে শোষণ করার মূল যন্ত্র হলো সরকার ও আধুনিক ব্যাংক।
সমাধান:
• আগে পরিশ্রম করব, পরে ভোগ করব -- এটাই ব্যক্তিজীবন ও জাতীয় জীবনের অর্থনীতির মূলনীতি হওয়া উচিত।
• ঋণ করে ঘি খাওয়াও উচিত নয়, ঋণ করে পদ্মাসেতু বানানোও উচিত নয়।
• জনগণ আগে টাকা দেবে, পরে সরকার ব্যয় করবে।

পর্ব-১৯: ইসলামী অর্থনীতি বনাম ঋণভিত্তিক অর্থনীতি 2/3
একটা শুকরকে যতই আপনি পানি খাইয়ে নিয়ম মোতাবেক বিসমিল্লাহ বলে জবাই করেন না কেন -- ঐটা আপনার জন্যে কল্যাণকর হয়ে যাবে না। হালালও হবে না। এবং ঐটা খেলে আপনি কোনোমতেই ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারবেন না। এবং আপনার কোরবানিও কবুল হবে না।
ঠিক তেমনি আপনার অর্থব্যবস্থা যদি কাগজের হয়, ব্যাংকিং সিস্টেম হয় ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যাংকিং, এবং রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি হয় ঋণভিত্তিক (credit-driven economy),
তাহলে --
তাহলে আপনি ব্যাংকের নামের শুরুতে যতই "ইসলামী" লাগান না কেন, এবং রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্র বলেন না কেন--
আপনি ব্যক্তিজীবনে ও জাতীয় জীবনে অকল্যাণ থেকে বের হতে পারবেন না, এবং ইসলামও কায়েম করতে পারবেন না।
মুদ্রাব্যবস্থা ও অর্থনীতি এতটাই ভাইটাল জিনিস। এটা একটা সমাজের রক্তের মত। মানবদেহের রক্ত যেমন দূষিত হয়ে গেলে তার শরীরে নানান পরজীবি এসে বাসা বাঁধে ও তাকে অসুস্থ করে ফেলে, তেমনি একটা সমাজের অর্থনীতি দূষিত হয়ে গেলে ঐ সমাজও ধুঁকে ধুঁকে মরতে থাকে। যতই আপনি মসজিদ বানান না কেন।
মানুষ দিনরাত খেটে রক্ত পানি করে তারপর দুইটা টাকা কামাই করে, আর সেই টাকা নিয়ে আপনি খেলবেন? জটিল অর্থব্যবস্থার মারপ্যাঁচে সেই টাকার মূল্য কমিয়ে দেবেন? তাহলেতো আপনি রক্ত চুষে খাচ্ছেন! কারণ ওটা টাকা না, ওটা ওর রক্ত, ঘাম, শ্রম। আর আপনার অর্থনীতি-মুদ্রানীতি-ব্যাংকনীতির কারণে ওর সেই রক্ত স্রেফ মাটিতে পড়ে যাচ্ছে…। কাগজের টাকা দিনদিন মূল্য হারাচ্ছে…।
কেবল inflation রেট ‘সীমিত’ রেখেছেন বলে জনগণ টের পাচ্ছে না।
ঠিক যেভাবে পাটক্ষেতের কৃষকের পায়ে অনেকগুলো জোঁক বসে বসে রক্ত খায়, সেরকম। কৃষক পাট কাটে কিন্তু টের পায় না যে, ওদিক দিয়ে ওর আধাকেজি রক্ত শেষ!

আমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসি তবে মানুষকে ভালোবাসব,
আর মানুষকে ভালোবাসলে তাকে জুলুমের শিকার হতে দিব না,
আর জোঁকের মত করে ধীরে ধীরে গোটা জাতির রক্ত চুষে খাওয়া এই অর্থব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-বিপ্লব ছাড়া কখনোই মানবের মুক্তি মিলবে না। এটা ছাড়া ইসলাম হবে না। সে নামাজ পড়বে ঠিকই, কিন্তু তার দেহে নীরব রক্তক্ষরণ হতে থাকবে। সেটা বন্ধ করার কোনোই দায়িত্ব কি আমাদের নেই?
আপনি যাকাত দেবেন ঠিকই, কিন্তু যাকাত নেওয়া গরীব মানুষটার টাকা চুরি হয়ে চলে যাবে পুঁজিবাদীদের হাতে -- সিম্পলি টাকার মান কমানোর মাধ্যমে।
আমাদের টাকা চুরি হয়ে যাচ্ছে -- টাকার মান কমার মাধ্যমে। আমাদের শ্রম চুরি হয়ে যাচ্ছে। রক্ত চুরি হয়ে যাচ্ছে…

মানি-মেকানিজম এর বিগত পর্বগুলো ভালো করে পড়ে থাকলে আপনি জানবেন যে --
• unbacked, floating fiat currency (সরকারের ছাপানো নোট, যার বিপরীতে কোনো গোল্ড নেই), এবং --
• Fractional reserve banking, এবং --
• Deficit spending (সরকার কর্তৃক ব্যাংক ঋণ নিয়ে আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করা), অর্থাৎ সর্বোপরি --
• Credit-driven economy বা ঋণভিত্তিক অর্থনীতি হলো এক সুবিশাল জোঁক, যা জাতির রক্ত চুষে খাচ্ছে প্রতিদিন এবং --
উত্থান ঘটছে পুঁজিবাদের।
পুঁজিবাদ বা ক্যাপিটালিজম কী? সমাজের গুটিকতক মানুষের হাতে পুঁজি/ ক্যাপিটাল/ সম্পদ জমা হওয়াকেই বলা হয় পুঁজিবাদ।
ধরেন আপনারা দশজন প্রত্যেকে এমাসে ২০ হাজার টাকা করে ইনকাম করলেন। তারপর সেটাকে বুকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকলেন। অতএব, কেউ চুরি করতে পারলো না। কিন্তু ঐ টাকাকে গুটিকয়েক লোক চুরি করবে। কিভাবে?
তা আপনারা জানেন।
টাকার মান কমানোর মাধ্যমে।
যখন পরদিন আপনি বাজারে গিয়ে দেখবেন যে, ঐ বিশটা ১ হাজার টাকার নোট দিয়ে হয়তো এক রোল টিস্যু পেপারও কিনতে পারছেন না।
আপনার হাতে রেখেই তারা টাকা চুরি করেছে। আর এই টাকা সিস্টেমেটিকালি সমাজের গুটিকতক লোকের হাতে গিয়ে জমা হয়েছে। কাদের হাতে?
যারা ব্যাংকিং সিস্টেম ও সরকারব্যবস্থার সাথে জড়িত, সেইসব ব্যবসায়ী ধনকুবেরের হাতে। যাদের হাতে ইন্ডিাস্ট্রি, যাদের ইন্ডাস্ট্রিতে আপনি কাজ করেন, যারা আবার অন্য হাত দিয়ে ব্যাংক চালায়, এবং সেখান থেকে টাকা ইস্যু করে, এবং আপনাকে বেতন দেয়, এবং তারাই আবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে আপনাকে শোষণ করে জোঁকের মত।

তাহলে, সত্যিকার ইসলামী অর্থনীতি হতে হলে আমাদেরকে --
• অবশ্যই গোল্ড এবং সিলভারকে মুদ্রা/ টাকা হিসেবে ব্যবহার করতে হবে,
• কখনোই ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যাংকিং করা যাবে না, বরং --
• ব্যাংকিং সিস্টেম চালু করলে অবশ্যই লক-ইন ব্যাংকিং করতে হবে, এবং
• রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি হতে হবে production-driven ও charity-driven.
একদিকে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা। যার হাতিয়ার হলো কাগজের নোট, ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যাংকিং ও সরকারের ডেফিসিট স্পেন্ডিং।
অপরদিকে ইসলামী অর্থব্যবস্থা। যার হাতিয়ার হলো গোল্ড/েসিলভার কয়েন, লক-ইন ব্যাংকিং এবং production ও charity.
শেষের দুটি টপিক সংক্ষেপে আলোচনা করছি।

Production-driven ইকোনমি কী? আগে প্রোডিউস করব, পরে ব্যয় করব। কেবলমাত্র প্রোডাকশন হলেই অর্থনীতির চাকা ঘুরবে, লেনদেন ঘটবে। এছাড়া ঘটবে না।
Charity কী? যাকাত, খুমস, বিভিন্ন পেনাল্টি, ইত্যাদি। এটা ইসলামী অর্থনীতির অনন্য বিশেষত্ব। কেননা দেখুন, গোল্ডকয়েন চালু করা, ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যাংকিং ও সরকারের ডেফিসিট স্পেন্ডিং বন্ধ করা -- ইত্যাদি পদক্ষেপ নেবার মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি রোধ করা -- একথা সেকুলার এক্সপার্টরাও বলবে। তারাও এটা জানে। বিভিন্ন ব্যাংকের হাই অফিশিয়ালরা এই তিনটা জিনিস খুব সহজেই পয়েন্ট আউট করে দেখিয়ে দেবে আপনাকে। কিন্তু --
কিন্তু ওগুলোর পাশাপাশি ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার হলো charity. ইসলামী অর্থনীতিতে -
• খুমস এর বিধান আছে। খুমস মানে এক পঞ্চমাংশ। অর্থাৎ, প্রাপ্ত ধনসম্পদের ২০%।
• যাকাত এর বিধান আছে। নিসাব পরিমাণ সম্পদের চেয়ে অতিরিক্ত যা থাকবে তার ২.৫%।
• এবং বিভিন্নরকম শাস্তির ক্ষেত্রে পেনাল্টি হিসেবে অর্থদণ্ড বা দরিদ্রকে খাওয়ানোর বিধান আছে।
• সর্বোপরি দান-সদকা করতে উৎসাহিত করা হয়েছে।
এটাই ইসলামী অর্থনীতির বিশেষত্ব। আমরা সবাই এই জিনিসগুলো জানি, কিন্তু আফসোস, আমরা এর গভীরতা ও অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষত্ব চিন্তা করি না। একদিকে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় সরকারী ট্যাক্স, অপরদিকে ইসলামী অর্থব্যবস্থায় খুমস, যাকাত ও অন্যান্য চ্যারিটি -- এই দুটির তুলনামূলক আলোচনা নিয়ে আর একটি পর্ব লিখেই এই সিরিজ শেষ করব ইনশাআল্লাহ।

পর্ব-২০:  ইসলামী অর্থনীতি বনাম ঋণভিত্তিক অর্থনীতি 3/3

দুই মিনিট সময় চেয়ে নিচ্ছি, সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছোট্ট কবিতাটা পড়ার জন্য:
ধনপতি পাল, তিনি জমিদার মস্ত;
সূর্য রাজ্যে তাঁর যায় নাকো অস্ত,
তার ওপর ফুলে উঠে কারখানা-ব্যাংঙ্কে
আয়তনে হারালেন মোটা কোলা ব্যাঙকে।
সবার “হুজুর” তিনি সকলের কর্তা,
হাজার সেলাম পান দিনে গড়পড়তা।
সদাই পাহারা দেয় বাইরে সেপাই তাঁর,
কাজ নেই, তাই শুধু ‘খাই-খাই’ বাই তাঁর,
এটা খান, সেটা খান, সব লাগে বিদঘুটে ,
টান মেরে ফেলে দেন একটু খাবার খুঁটে;
খাদ্যে অরুচি তাঁর, সব লাগে তিক্ত,
খাওয়া ফেলে ধমকান শেষে অতিরিক্ত।
দিনরাত চীৎকারঃ আরো বেশি টাকা চাই,
আরো কিছু তহবিলে জমা হয়ে থাকা চাই।
সব ভয়ে জড়োসড়ো, রোগ বড় প্যাঁচানো।
খাওয়া ফেলে দিন রাত টাকা বলে চ্যাঁচানো।
ডাক্তার কবিরাজ ফিরে গেল বাড়িতে;
চিন্তা পাকালো জট নায়েবের দাড়িতে।
নায়েব অনেক ভেবে বলে হুজুরের প্রতি:
কী খাদ্য চাই? কী সে খেতে উত্তম অতি?
নায়েবের অনুরোধে ধনপতি চারিদিক
দেখে নিয়ে বার কয় হাসলেন ফিক্-ফিক্;
তারপর বললেন: বলা ভারি শক্ত,
সব চেয়ে ভাল খেতে গরীবের রক্ত।।

কবিতার নাম: ভাল খাবার।

মোদ্দা কথা হলো, নানান কারখানা আর ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে জমিদার বাবু ফুলে ফেঁপে উঠেছেন, এবং কোনো খাবারই তার ভালো লাগে না। শেষমেষ সেক্রেটারি এসে সাহস করে জিজ্ঞাসা করে: “আসলে ঠিক কোন খাবারটা খেতে আপনার সবচে' ভালো লাগে?”
এদিক ওদিক তাকিয়ে হেসে দিয়ে জমিদার বলে:
"সব চেয়ে ভাল খেতে গরীবের রক্ত।"
যাহোক, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার তিনটি হাতিয়ার কিভাবে জোঁকের মত করে গোটা জাতির রক্ত চুষে খাচ্ছে, তা আলোচনা করেছি। এবং বিপরীতে ইসলামী অর্থনীতির বিশেষত্বও দেখিয়েছি, সেটা নিয়ে কেবল আজকে শেষ আলোচনাটুকু করতে চাই।

বলেছিলাম যে, যেকোনো সেকুলার এক্সপার্টও আপনাকে দেখিয়ে দেবে যে, টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কাগজের নোট বাদ দিয়ে স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহার করতে হবে, ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যাংকিং বাদ দিয়ে লক-ইন ব্যাংকিং চালু করতে হবে, এবং সরকারের deficit spending বাদ দিয়ে production-driven spending করতে হবে। কিন্তু এখানেই ইসলামী অর্থনীতির কথা শেষ নয়। বরং ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার হলো:
• খুমস (অতিরিক্ত সম্পদের ২০%)
• যাকাত (অতিরিক্ত সম্পদের ২.৫%)
• দান-সদকা
খুমস ও যাকাত হলো ইসলামিক ট্যাক্স। হয়ত ভাবছেন, সেকুলার সরকারও তো ট্যাক্স নেয়। তাহলে এবার দুইরকম ট্যাক্স এর মৌলিক পার্থক্য দেখি আসেন।

ট্যাক্স কী?
ট্যাক্স হলো জনগণের কাছ থেকে নেয়া টাকা, যা সরকার "জনকল্যাণমূলক কাজে" ব্যয় করবে।
আচ্ছা, ধরেন, আপনি না খেয়ে আছেন, এমন সময় আমি এসে আপনাকে খুব দামী একটা লোশন কিনে দিয়ে বললাম: "তোমার কল্যাণ হোক, এই শীতে স্কিনের যত্ন নিও।"
আরে রাখেন আপনার স্কিন কেয়ার! পেটে ভাত আগে!
তাহলে দেখা যাচ্ছে, কল্যাণের একটা লিস্ট আছে। আগের জিনিস আগে, পরের জিনিস পরে। আগের জিনিস কী?
• অন্ন
• বস্ত্র
• বাসস্থান
• চিকিৎসা
• (নৈতিক-ধর্মীয়) শিক্ষা
(এরপর স্কিন কেয়ার, কমফোর্টেবল জামা-জুতা, পাকা রাস্তা, ফ্লাই্ওভার ইত্যাদি…)
তো, এইযে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান ইত্যাদি যে প্রতিটা মানুষের মৌলিক চাহিদা, এটা পূরণ করা কি সরকারের দায়িত্ব?
না।
এটা পূরণ করা প্রতিটা ব্যক্তির নিজের দায়িত্ব।
আপনার মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে মাসে ২০ হাজার টাকা লাগে। তারপর আর এক টাকাও থাকে না।
এখন সরকার যদি এসে বলে: তোমার ঐ ২০ হাজার টাকার উপর ১৫% ট্যাক্স দাও, এটা আমি তোমার (অর্থাৎ জনগণের) কল্যাণে কাজে লাগাবো।

কী কল্যাণ? ফ্লাইওভার বানাবো, পদ্মাসেতু বানাবো।
বাহ! তারপর সে আমার ৩ হাজার টাকা ট্যাক্স কেটে নিয়ে গেল! তারপর আমি ১৭ হাজার দিয়ে মাস চলব কিভাবে? আমিতো ভালোই ছিলাম! আমারতো মৌলিক চাহিদাগুলো ঠিকই পূরণ হচ্ছিলো! এখন ১৭ হাজারে মাস চলতে গিয়ে আমি ঠিকমত খেতে পারছি না, আর ঠিকমত বাজার করলে বাসা ভাড়া দিতে পারছি না, বাসা ভাড়া ঠিকমত দিলে ডায়বেটিসের ওষুধ কিনতে পারছি না…। অর্থাৎ, এক মহা টানাটানিতে পড়ে গেলাম!
সরকার আমাকে পেটের ক্ষুধায় রেখে "জনকল্যাণমূলক কাজ" করছে! আমার "কল্যাণ" করছে! পদ্মাসেতু বানাচ্ছে! বাহ!
আরে ভাই, যাদের মাসে ২০ হাজার টাকার বেশি ইনকাম, ওদের থেকে আপনি যত খুশি ট্যাক্স নেন, তারপর সেটা দিয়ে পদ্মাসেতু বানান ফ্লাইওভার বানান যত খুশি জনকল্যাণমূলক কাজ করেন!

সেকুলার কেউ এসে বলবে, "হ্যাঁ, সেটাই করা হয় জনাব! ইনকাম ট্যাক্স এর একটা মিনিমাম লেভেল আছে। মানুষের মৌলিক চাহিদা মিটাতে monthly যত টাকা দরকার হয়, তার চেয়ে বেশি ইনকাম হলেই কেবল তার উপর ইনকাম ট্যাক্স ধার্য করা হয়।"
বেশতো, ভালো কথা। তা জনাব, এইযে বাজার থেকে এক প্যাকেট হলুদের গুঁড়া কিনতে গেলে যে তার উপর ১৫% ট্যাক্স দিতে হয়! (ট্যাক্স সহ হিসাব করেই মোট দামটা লেখা হয় প্যাকেটের গায়ে, আর আপনি সেটাই দোকানির হাতে তুলে দেন, দোকানি ট্যাক্সের অ্যামাউন্টটুকু সরকারের কাছে জমা দেয়)।
মরিচের গুঁড়ো কিনতে গেলে যে ওর উপর ১৫% ট্যাক্স আছে! টুথপেস্ট কিনতে গেলে যে ট্যাক্স আছে! দোকান থেকে যত যা কিনি, সবকিছুর উপরেই তো ১৫% ট্যাক্স দিয়ে রেখেছেন!
তো যে গরীব মানুষকে ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয় না, সে-ও কি ট্যাক্সের আওতামুক্ত আছে? না। তাকেও এখানে সেখানে নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রে সবখানে ১৫% ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। ট্যাক্স দেয়া ছাড়া সে কেনাকাটাই করতে পারছে না। সে দোকানিকে বলতে পারছে না যে: "ভাই আমি গরিব মানুষ, হলুদের গুঁড়াটা ট্যাক্স বাদ দিয়ে মূল দামটাই রাখো!"
অতএব, সরকার যদিও গরীব মানুষের ইনকাম ট্যাক্স নেয় না, কিন্তু ঠিকই তার থেকেও রক্ত চুষে খায়।
"সব চেয়ে ভাল খেতে গরীবের রক্ত।" (আর বড়লোকরা তো ট্যাক্স ফাঁকি দেয়!)

ঐযে, বলেছিলাম না -- আপনি মাসের বেতন ২০টা এক হাজার টাকার নোট বুকের মধ্যে আগলে রাখবেন যেন কেউ চুরি করতে না পারে, কিন্তু ঠিকই তারা চুরি করবে -- কীভাবে? টাকার মান কমিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। পরদিন সকালে উঠে দেখবেন, ঐ কাগজ একেবারেই মূল্যহীন হয়ে গেছে!
তেমনিভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় নানান জিনিসপত্রের উপরে value added tax (VAT) বসিয়ে গরীবের রক্তটাও চুষে খাচ্ছে। ঠিকই ওর কাছ থেকেও ১৫% করে নিয়ে যাচ্ছে।

লেখা আর বেশি বড় করব না। ইসলামিক ট্যাক্স কেবলমাত্র তাদের উপরেই প্রযোজ্য, যারা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার পর "অতিরিক্ত সম্পদ" রয়ে যায়। সেই অতিরিক্ত সম্পদের উপর ২.৫% যাকাত ও ২০% খুমস প্রযোজ্য। এটা ইসলামিক ট্যাক্স। ইসলামী সরকারের আয়ের বড় উৎস। এবং সেটা গরীবের উপর জুলুম না করেই।

লক্ষ্য করুন, ইসলামী অর্থনীতিতে ইসলামী সরকার:
• কাগজের নোট, ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যাংকিং ও ডেফিসিট স্পেন্ডিং করে মুদ্রাস্ফীতি ঘটিয়ে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে জনগণকে শোষণ করবে না
• গরীবের থেকে কৌশলে ট্যাক্স নিয়ে জনকল্যাণের নামে ক্ষুধার্তকে বডি লোশন গিফট করবে না।

বরং, একই প্রকৃত ইসলামী সরকার আল্লাহপাকের বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষকে স্বাধীনভাবে উপার্জন করতে দেবে। এরপর যেসকল মানুষ মৌলিক চাহিদা পূরণের পরও তাদের অতিরিক্ত সম্পদ রয়ে যাবে, তাদের উপর ইসলামিক ট্যাক্স প্রয়োগ করবে। এবং সেই টাকা দিয়ে জনকল্যাণমূলক কাজ করবে। গরিবের পেটে কখনোই লাথি দেবে না। এবং এটা সম্ভব হবে:
• গোল্ড / সিলভার ব্যবহারের মাধ্যমে
• লক-ইন ব্যাংকিং এর মাধ্যমে
• সরকারের production-driven spending এর মাধ্যমে, এবং
• ইসলামী ট্যাক্স গ্রহণ করার মাধ্যমে।
উপরের অর্থনীতির আলোচনাগুলো কুরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে নেয়া হয়েছে। আলোচনা সংক্ষিপ্ত রাখার স্বার্থে সেগুলি উল্লেখ করবেন না।
মানি মেকানিজম সিরিজটা শেষ হলো। ধন্যবাদ।

নূরে আলম মাসুদ
নভেম্বর, ২০১৭

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধর্মব্যবসা: মুসলমানদের হাতে ইসলাম ধ্বংসের অতীত-বর্তমান (১)

ভূমিকা যদিও পলিটিকাল-রিলিজিয়াস ইস্যুতে নিশ্ছিদ্র আর্গুমেন্ট উপস্থাপন করে আলোচনা করার অভ্যাস আমার, কিন্তু এখানে বিস্তারিত ইতিহাস তুলে ধরে আর্গুমেন্ট করার প্রথমতঃ ইচ্ছা নেই, দ্বিতীয়তঃ সময় ও সুযোগ নেই। আমি যা সত্য বলে জানি, তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি। যারা আমার উপর আস্থা রাখেন তাদের জন্য এই লেখাটি সোর্স অব ইনফরমেশান, উন্মুক্ত হৃদয়ের মানুষদের জন্য সত্য অনুসন্ধানের নতুন কিছু টপিক, আর প্রেজুডিসড ধর্মান্ধ রোগগ্রস্ত অন্তরের জন্য রোগ বৃদ্ধির উছিলা। শেষ পর্যন্ত আর্গুমেন্ট ও ডায়লগের দুয়ার উন্মুক্ত রাখার পক্ষপাতী আমি, কিন্তু সেই আর্গুমেন্ট অবশ্যই সত্য উন্মোচনের নিয়তে হওয়া উচিত, নিজের দীর্ঘদিনের লালিত বিশ্বাস ও ধ্যান ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করবার উদ্দেশ্যে নয়। মক্কা-মদীনা: মুহাম্মদ (সা.) থেকে আলে-সৌদ (৬২৯-১৯২৪) এদেশের অধিকাংশ মানুষ মক্কা-মদীনার ইতিহাস কেবল এতটুকু জানেন যে, মুহাম্মদ (সা.) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন। কিন্তু প্রায় চৌদ্দশ’ বছর আগে মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র থেকে আজকের রাজতান্ত্রিক সৌদি আরবের ইতিহাস কম মানুষই জানেন। প

পিস টিভি, জাকির নায়েক ও এজিদ প্রসঙ্গ

সম্প্রতি গুলশান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। আমি তখন দিল্লীতে ছিলাম। দেশে ফিরে শুনি পিস টিভি ব্যান করা হয়েছে বাংলাদেশে, এবং তার আগে ইন্ডিয়াতে। আমার বাসায় টিভি নেই, এবং আমি জাকির নায়েকের লেকচার শুনিও না। কিংবা পিস টিভিতে যারা লেকচার দেন, বাংলা কিংবা ইংলিশ -- কোনোটাই শুনি না; প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া আমার ইসলামের বুঝ জাকির নায়েকসহ পিস টিভি ও তার বক্তাদেরকে ইন জেনারেল আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। Peace TV বন্ধ হওয়ায় এদেশে বিকৃত ইসলাম প্রসারের গতি কমলো -- এটাই আমার মনে হয়েছে। একইসাথে আমি এটাও মনে করি যে, যেই অভিযোগ পিস টিভিকে ব্যান করা হয়েছে, তা নিছক অজুহাত। জাকির নায়েক কখনো জঙ্গীবাদকে উস্কে দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। কিংবা পিস টিভির লেকচার শুনে শুনে ISIS জঙ্গীরা সন্ত্রাসী হয়েছে -- এটা নিতান্তই হাস্যকর কথা। ISIS এর ধর্মতাত্ত্বিক বেইজ সম্পর্কে মোটেও ধারণা নেই, এমন লোকের পক্ষেই কেবল ISIS এর জন্য জাকির নায়েককে দোষ দেয়া সম্ভব। একইসাথে আমি এ বিষয়েও সচেতন যে, পিস টিভি বন্ধ করা হয়েছে আমাদের সরকারের রেগুলার “ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের অংশ