সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পিস টিভি, জাকির নায়েক ও এজিদ প্রসঙ্গ

সম্প্রতি গুলশান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। আমি তখন দিল্লীতে ছিলাম। দেশে ফিরে শুনি পিস টিভি ব্যান করা হয়েছে বাংলাদেশে, এবং তার আগে ইন্ডিয়াতে।


আমার বাসায় টিভি নেই, এবং আমি জাকির নায়েকের লেকচার শুনিও না। কিংবা পিস টিভিতে যারা লেকচার দেন, বাংলা কিংবা ইংলিশ -- কোনোটাই শুনি না; প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া আমার ইসলামের বুঝ জাকির নায়েকসহ পিস টিভি ও তার বক্তাদেরকে ইন জেনারেল আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। Peace TV বন্ধ হওয়ায় এদেশে বিকৃত ইসলাম প্রসারের গতি কমলো -- এটাই আমার মনে হয়েছে।


একইসাথে আমি এটাও মনে করি যে, যেই অভিযোগ পিস টিভিকে ব্যান করা হয়েছে, তা নিছক অজুহাত। জাকির নায়েক কখনো জঙ্গীবাদকে উস্কে দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। কিংবা পিস টিভির লেকচার শুনে শুনে ISIS জঙ্গীরা সন্ত্রাসী হয়েছে -- এটা নিতান্তই হাস্যকর কথা। ISIS এর ধর্মতাত্ত্বিক বেইজ সম্পর্কে মোটেও ধারণা নেই, এমন লোকের পক্ষেই কেবল ISIS এর জন্য জাকির নায়েককে দোষ দেয়া সম্ভব।
একইসাথে আমি এ বিষয়েও সচেতন যে, পিস টিভি বন্ধ করা হয়েছে আমাদের সরকারের রেগুলার “ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের অংশ” হিসেবে, এই জন্য নয় যে জাকির নায়েকের পিস টিভি থেকে বিকৃত ওহাবী সালাফি ইসলাম প্রচার হয়, কিংবা এইজন্য নয় যে জাকির নায়েক এজিদ সমর্থক লোক। আজকে হয়তো সরকারের খড়গ নেমে এসেছে বিকৃত ইসলাম প্রচারকারী একটি টিভি চ্যানেলের উপর, কাল হয়ত খাঁটি মুহাম্মদী দ্বীনের প্রচারকারীদের উপর খড়গ নেমে আসবে, অতীতেও এসেছে। অতএব, আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে যে পিস টিভি বন্ধ হয়েছে, এটা একদিক দিয়ে ভালো নয়, কারণ খাঁটি ইসলাম প্রচারকারী চ্যানেলও তারা বন্ধ করে দিবে। তবে পিস টিভি বন্ধ হওয়াটা আরেক দিক দিয়ে ভালো হয়েছে, কারণ মানুষের মাঝে বিকৃত ইসলাম প্রসারের গতি কিছুটা কমলো। আওয়ামী লীগ অ্যাকসিডেন্টালি একটি ভালো কাজ করে ফেলেছে পিস টিভি বন্ধ করে। অনেকটা বাঘের হামলায় ডাকাতের মৃত্যুর মতন ব্যাপার। তবে বাঘ আবার নামাজরত মানুষকেও হত্যা করতে পারে। এসবই বাস্তবতা।


সরকার কেন দেওয়ানবাগীর কার্যক্রম বন্ধ করে না? সরকার সেটা কখনো করবেও না, কেননা, নিজেকে আল্লাহ দাবী করা দেওয়ানবাগী সুস্পষ্ট ধর্মব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষকে ভুলিয়ে কোটি কোটি টাকা পকেটস্থ করছে, এবং পুলিশ থেকে শুরু করে সরকারের সকল পর্যায়ে টাকা দিচ্ছে। সরকার কেন শুধু শুধু টাকার উৎস বন্ধ করবে? আর (দেওয়ানাবগীর) বিকৃত ইসলামের প্রচার প্রসারে তারাতো উদ্বিগ্ন হয় না, বরং মেবি খুশি হয়।


যাহোক, আমি জানি অনেকেরই “পিস টিভি” বা “জাকির নায়েক” এর সাথে বিকৃত ইসলাম কথাটা শুনতে খারাপ লাগছে, রাগ হচ্ছে, এবং আমাকে ভিনদেশী এজেন্ট, কাফির, মুরতাদ ইত্যাদি বহু কিছু ভাবছেন। কিন্তু সেসব সরিয়ে রেখে আমি কেবল কিছু তথ্য উপস্থাপন করতে চাই। যে ইসলাম পিস টিভিসহ নানান মাধ্যমে আমি না চাইতেই আমার দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত হয়, সেগুলিও আমি পড়েছি, দেখেছি, শুনেছি। কিন্তু এর বাইরে নিজে থেকে সত্য সন্ধানের যতটুকু চেষ্টা করেছি, তাতে ইসলামের যে বুঝ আমি পেয়েছি, তার ভিত্তিতে কিছু তথ্য উপস্থাপন করতে চাই। আশা করি, সত্যানুসন্ধানী মানুষদের জন্য তা উপকারী হবে। আর যারা বিরক্ত হচ্ছেন, ঘৃণা করছেন, তাদেরও উপকার হবে, কেননা যুক্তির কথা একবার মাথায় ঢুকে গেলে দশ বছর পরে হলেও তা আপনি নীরবে মেনে নিতে পারেন। যুক্তির শক্তি এখানেই। সত্যের শক্তি এখানেই। Truth travels itself. অতএব, (ঘৃণা করার জন্যে হলেও) শেষ পর্যন্ত পড়বেন আশা করি।


জাকির নায়েক ইয়াজিদের নামের সাথে রাদিয়াল্লাহ আনহু পড়েছেন। একইসাথে কারবালার যুদ্ধকে “পলিটিকাল ওয়ার” বলেছেন। এজিদকে গুড পারসন বলেছেন। এই নিয়ে আলেম সমাজে তোলপাড় হয়ে গেছে। শিয়া সমাজেতো উনার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই-ই, সুন্নি আলেম সমাজে যতটুকুওবা গ্রহণযোগ্যতা ছিল, সেটুকুও গেল একথা বলায়। মিডিয়াতে পর্যন্ত উপস্থিত হয়ে তথ্য প্রমাণ দিয়ে উনাকে জানানো হলো, উনি যেই রেফারেন্সের ভিত্তিতে বলছেন ইয়াজিদ জান্নাতি হবে, সেটা উনি বিকৃত করেছেন। মূল হাদীসটিও বলে দেয়া হলো। তারপর উনি জবাব দেয়া বন্ধ করে দিলেন। উনার নিজের মতের উপরেই স্ট্রিক্ট থাকলেন।


অনেকে বলবেন, হয়ত একটি বিষয়ে উনি ভুল করেছেন, বাকি বিষয়েতো উনার সঠিক কথাগুলি মেনে নেয়া যায়। কিন্তু না, আমি এর পিছনে যে সমস্যা দেখছি, তা ভিন্ন। এরকম একজন ব্যক্তি, যিনি কোটি কোটি মানুষের সামনে স্টেজে দাঁড়ান, তিনি যদি নিজের ভিতরে গোঁড়ামি পুষে রাখেন, এবং “একবার বলে ফেলেছি, অতএব আর সংশোধন করব না” -- এই মানসিকতার হয়ে থাকেন (যার প্রমাণ তিনি এজিদের ক্ষেত্রে দিয়েছেন), তাহলে তিনি ভবিষ্যতে আরো গুরুতর ইস্যুতে ভুল করার পরও সেটার উপরেই গোঁড়ামি করতে থাকবেন, এবং কোটি কোটি মানুষ ভুল জিনিস জানবে। আপনি জানেন, ইসলামের বিষয়গুলিতে deal করতে হলে কতটা সতর্কতার সাথে করতে হয়? আজকে উনি এজিদের নামের সাথে রাদিয়াল্লাহু আনহু বলছেন, এবং তাই শুনে কমজ্ঞানী লোকেরা বলছে, এজিদ সাহাবী ছিলেন। কেন বলছে, জানেন? কারণ তারা এভাবে চিন্তা করছে: “রাদিয়াল্লাহু আনহু তো সাহাবীদের নামের সাথে পড়া হয়। জাকির নায়েকের মত জ্ঞানী মানুষ, যিনি পড়াশুনা করা ছাড়া কথা বলেন না, তিনি এজিদের নামের সাথে রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন। অতএব, এজিদ নিশ্চয়ই সাহাবি ছিল!” অথচ এজিদের জন্ম নবীজির মৃত্যুর অনেক পরে, ২৬ হিজরিতে‍! এরপর কী হবে জানেন? এরপর আগামী ৫০ বছর পর, যখন জাকির নায়েক “বিংশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ” নামে সর্বত্র প্রচারিত হবেন, তখন ইসলাম বিকৃতকারী শয়তানেরা জাকির নায়েকের রেফারেন্সে বলবে যে এজিদ সাহাবী ছিল। সেইসাথে দুটি কাজ করবে। এজিদের জন্মসাল ২৬ হিজরি, এটাকে “বিতর্কিত” হিসেবে উপস্থাপন করবে, এবং একইসাথে কিছু হাদীস তৈরী করবে, যেটাতে আল্লাহ রাসুল (সা.) এজিদকে পিছনে নিয়ে নামাজ পড়েছেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছেন যে তুমি একদিন মুসলিম জাহানের খলিফা হবে -- এজাতীয় বানোয়াট কথা থাকবে। তারও দুইশত বছর পর “এজিদ সাহাবী ছিলেন, উনার বিরোধিতা করলে ডাইরেক্ট জাহান্নাম” -- একথা এস্টাবলিশ হয়ে যাবে!


না, আমি কোনো কাল্পনিক কথা বলছি না। ইসলামের ইতিহাসে বিগত ১৪০০ বছরে এমন ঘটনা ঘটেছে। সত্য গোপন করা, জাল হাদীস তৈরী করা, (জন্মসূত্রে) মুসলিম রাজা-বাদশাহদের নিজেদের পক্ষে নানান ইতিহাস রচনা করা, এবং কালের প্রবাহে সেগুলিতে “প্রতিষ্ঠিত সত্য” হিসেবে ধরে নিয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা -- এসব কাজ হয়ে এসেছে। যেকারণে সালাফি ধারা আজকে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। অথচ সালাফি ধারা কী বলে? তারা বলে যে, কুরআন ও হাদীস বুঝতে হবে সেইভাবে, যেইভাবে সাহাবীরা বুঝেছিলেন, সলফে-সালেহীনরা বুঝেছিলেন। অতএব তারা সাহাবীদের ইন্টারপ্রিটেশান গ্রহণ করে। আর সাহাবীর সংজ্ঞা কী? (তাদের মতে) যারা নবীজিকে একবার হলেও চোখে দেখেছিলেন, তারাই সাহাবী। অতএব, সূরা মুনাফিকুন যাদেরকে উদ্দেশ্যে করে নাযিল হয়েছিল, নবীজির বাহ্যিক সঙ্গী সাথীদের মাঝে থাকা সেইসব মুনাফিকরাও বিশেষ মর্যাদা পেয়ে গেল, এবং অনুসরণযোগ্য হয়ে গেল। অতঃপর এমন ইসলাম দিয়ে যা খুশি তাই করা যাবে! বাহ্যিক সাহাবী ও আত্মিক সাহাবী যে ভিন্ন জিনিস, সেকথা তারা বেমালুম চেপে গেল!


আজকে জাকির নায়েক ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের সমস্ত তাৎপর্যকে ম্লান করে দিয়ে এটাকে সিম্পলি “পলিটিকাল ওয়ার” বলছেন (অর্থাৎ ক্ষমতার লড়াই), শিয়া-সুন্নি মতপার্থক্যকে পলিটিকাল বলছেন (অর্থাৎ ইমাম আলী (আ.) এর ক্ষমতার লড়াই (!) ), এজিদের নামের উপর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলছেন -- আপনারা কি মনে করেন এগুলো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয়? অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ মনে না করাটাই স্বাভাবিক, কেননা এ অঞ্চলের মানুষকে বিগত ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে “ইসলাম” ও “ইসলামের ইতিহাস” রেডি ট্যাবলেট করে দেয়া হয়েছে। সেই ইতিহাসে ইমাম হুসাইন (আ.) নাই, ইমাম হাসান (আ.) নেই, ইমাম আলী (আ.) নেই, এবং নেই নবীজির জীবনের আরো অনেক কিছুই। সে ইতিহাসে নেই নবীজির সেই মক্কা-মদীনার হেজাজ কিভাবে আলে সৌদের নামে “সৌদি আরব” নাম ধারণ করলো। জানেন, অনেক মানুষ মনে করে যে, আজকের সৌদি আরবের যেই বর্ডার, এই বর্ডারের এলাকার নাম নবীজির সময়েই সৌদি আরব ছিল? অনেকে মনে করে “সৌদি আরব” নামক দেশে নবীজির জন্ম হয়েছে! কারো কাছে অবিশ্বাস্য লাগতে পারে। আমার কাছেও অবিশ্বাস্য লেগেছে, যখন কিছুদিন আগে জাকির নায়েক সংক্রান্ত পোস্টে একজনের কমেন্ট পেলাম: এজিদ সাহাবী ছিল!


জাকির নায়েক বুশকে টেরোরিস্ট বলছেন, কখনো কি আলে সৌদকে টেরোরিস্ট বলেছেন? তিনি কি দেখেন না যে, গত দুই বছর যাবৎ সৌদি বাদশাহ ইয়েমেনে সিভিলিয়ানদের হত্যা করছে? কেন তিনি নীরব? তিনি কি আলে সৌদের ইতিহাস জানেন না, তিনি কি জানেন না যে সৌদি বাদশাহরা ইহুদি-ব্রিটিশ-মার্কিন সেবাদাস ভেড়া? মাত্রতো শ’খানেক বছর আগের ইতিহাস, তিনি কি জানেন না? তা সত্ত্বেও তিনি সৌদি বাদশাহর কাছ থেকে ইসলামের খেদমত করার জন্য পুরস্কার পান। যেমন বাদশাহ, তেমন তার ইসলাম, আর তেমন সেই ইসলামের খাদেম!


কোটি কোটি ডলার ব্যয়ে দুনিয়াব্যাপী “পিস টিভি” ও তাদের কার্যক্রমে এমন ইসলামই প্রচার হয়ে আসছে। যেই ইসলামে এজিদ একজন জান্নাতি মানুষ। জানেন, এদেশে মাদরাসাগুলোতে এমন বিকৃত ইসলাম প্রচার করা হয় যে, সেখানে বলা হয়, ইমাম হুসাইন (আ.) ভুল করেছিলেন কারবালায় গিয়ে, আমরা উনার মুক্তির জন্য দোয়া করি (!?)। হায়রে, জান্নাতের যুবকদের সর্দারের মুক্তির জন্য কে দোয়া করে? যে নিজে মুক্তির জন্য তার শাফায়াতের মুখাপেক্ষী? হায়রে!


এখন, আমার এতসব কথা আপনার কাছে সিভিয়ার কিছু মনে না-ও হতে পারে, যদি আপনি এজিদ আসলে কী ছিল, তা না জেনে থাকেন, যদি এজিদ সম্পর্কে আপনার জ্ঞান অর্জনই হয়ে থাকে ওহাবী সালাফী দুষ্টচক্রের হাত ধরে। এদেশের ট্র্যাডিশনাল মোল্লারা জেনে বা না জেনে কী করেছে, কী করে, জানেন? এক্সেপশনাল থাকতে পারে, কিন্তু তাদের অধিকাংশই জেনেশুনে কুরআনের আয়াত গোপন করে। কখনো মানুষকে সূরা বাকারার ১৮৭ নাম্বার আয়াত থেকে বলে না যে, রোজা পূর্ণ করো রাত পর্যন্ত, সন্ধ্যা পর্যন্ত নয়। কেননা তাহলে মানুষ যদি দেখে যে আহলে বাইতের অনুসারীরা রাতে ইফতার করছে, আর তারাই সঠিক! তখন যে অনুসারী ছুটে যাবে, ধর্মব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে! সৌদি আরবতো ইদানিং এককাঠি বেড়ে অনুবাদে লিখে দিয়েছে: till sunset. আর সব অনুবাদে আরবি “লাইল” এর অনুবাদ “রাত, night” ইত্যাদি করা হয়েছে। কেবল কাজের বেলায় পালন করেছে উল্টো। কিন্তু সৌদি আরবের “সহীহ ইন্টারন্যাশনাল” ভাবলো, অনুবাদে “night” দেখে যদি লোকে আবার রাতে ইফতার শুরু করে দেয়! তাই তারা লাইল এর অনুবাদে লিখে দিল sunset, অর্থাৎ মাগরিব! quran.com/2/187 তে গিয়ে দেখেন, আর ট্রান্সলেশন থেকে বাংলাসহ অন্যান্য ইংরেজি ট্রান্সলেশন চেক করে দেখেন!


তারা কখনো বলে না কুরআন শরীফে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে তোমাদের অভিভাবক হলেন আল্লাহ, তার রাসুল ও সেইসব লোকেরা, যারা রুকু অবস্থায় দান করে। -- তাহলে যে মানুষ জিজ্ঞাসা করবে, রুকু অবস্থায় দান করেছিল কে, যার জন্যে এই আয়াত নাযিল হয়েছিল? তাহলে যে উত্তরে বলতে হবে হযরত আলী (আ.) এর কথা, আর তাহলেই যে অনুসারী ছুটে যাবে, মানুষ যে বলবে, তাহলেতো আহলে বাইতের অনুসারীরাই সত্য কথা বলে, তারা কেবলমাত্র আল্লাহ, মুহাম্মদ (সা.) ও তার পরে অভিভাবক হিসেবে হযরত আলী (আ.) কে মানে! কেননা কুরআনে সেটাই বলা আছে! এজন্যে তারা কুরআনের সেই আয়াতের অনুবাদও বিকৃত করে ফেলেছে: “যারা নামাজ পড়ে ও দান করে”!


কুরআনের আয়াতে বলা হয়েছে, “সেদিন আমি প্রত্যেক দলকে তাদের ইমাম সহকারে ডাকব” -- এখন যদি এই কথা লোকে জানতে পারে, তাহলে যে তারা বলবে, ইমাম বলতে কী বুঝায়? আহলে বাইতেরা অনুসারীরা যেই বারো ইমামের কথা বলে, সেরকম কিছু নাকি? সেজন্যে তারা ঐ আয়াতের অনুবাদই বিকৃত করে দিয়েছে, লিখেছে: সেদিন আমি প্রত্যেককে তার আমলনামা সহকারে ডাকব! ইমাম অর্থ কি আমলনামা?


নবী ইবরাহীম (আ.)কে আল্লাহ তায়ালা কিছু পরীক্ষা নিলেন এবং তিনি উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাঁকে মানবজাতির “ইমাম” এর মর্যাদা দিলেন -- সেই আয়াতগুলোর আলোচনা কি কখনো শুনেছেন? শুনবেন না। কেননা, তাহলে মানুষ বলবে, ইমামত কি তাহলে নবুওয়্যাতের মতই আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত কোনো পদ / মর্যাদা? তাহলে আহলে বাইতের অনুসারীরা যে বারো ইমামের কথা বলে, সেটাই বা কী? অতএব, সেই আয়াতের আলোচনাই বাদ!
তাছাড়া, সেই আয়াতে যে আল্লাহ বলে দিয়েছেন যে ইবরাহীম (আ.) এর বংশ থেকেই পরবর্তী সকল ইমাম মনোনীত হবেন, তবে শর্ত হলো তারা জালিম হবেন না (নিষ্পাপ-নির্ভুল হবেন) -- এসব আলোচনা করলে যে প্রশ্ন আসবে, ইবরাহীম (আ.) এর পরবর্তী ইমাম কে / কারা ছিলেন/ আছেন? তাহলেই যে ধর্মব্যবসা ছুটে যাবে, মানুষ যে আহলে বাইতের অনুসারী আলেমদের কাছে চলে যাবে! তাহলে যে বারো ইমামের ইমামতের বিরুদ্ধে যে যুক্তি দেয়া হয় -- “বংশাধারায় নেতৃত্বের এসব রাজতন্ত্র ইসলামে নাই” -- সেই যুক্তি যে ইনভ্যালিড হয়ে যাবে!


যেই ইউসুফ আলীর অনুদিত কুরআন জাকির নায়েকের হাতে থাকে, জানেন উনার মৃত্যুর পর সেই অনুবাদের টিকা বিকৃত করা হয়েছে? ইমাম হাসান-হোসেনের শাহাদাতের মর্যাদা সংক্রান্ত কথাগুলি উনার টিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে? আমার কাছে প্রায় অর্ধযুগের পুরনো ইউসুফ আলীর কুরআন আছে, নিজে যখন দেখলাম, অবাক হয়ে গেলাম। ইমাম হাসান-হোসেনের সাথে তোমাদের এতই শত্রুতা!


হ্যাঁ, জাকির নায়েক, উনার পিস টিভি -- ইত্যাদি দিয়ে উনারা মানুষের ইসলামী জ্ঞান অর্জনের যে চাহিদা, তা পূরণ করে দিচ্ছেন। এবং সেখানে দিচ্ছেন বিকৃত ইসলাম। একজন ক্ষুধার্ত মানুষকে যদি কেউ বিষাক্ত ফরমালিনযুক্ত ফল খেতে দেয়, আমরা হয়ত তাকে সাধারণ চোখে বাহবা দেব। কিন্তু একজন ডাক্তার, যিনি এর সুদূরপ্রসারী খারাপ প্রভাব জানেন, তিনি অবশ্যই নিষেধ করবেন, এবং সেই ব্যক্তিকে অপছন্দ করবেন, যে জেনেশুনে ফরমালিনযুক্ত ফল ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়াচ্ছে।


আমি আর বেশি কিছু লিখলাম না। আগে অনেক তথ্যবহুল করে লেখার চেষ্টা করতাম। ইদানিং মনে হয়, সত্যানুসন্ধানীদের জন্য কেবল কিছু হিন্টস-ই যথেষ্ট। এখানে কিছু হিন্টস রেখে গেলাম। জানেন, সিহাহ সিত্তায় বিদায় হজের ভাষণের সবচে বেশি বর্ণনা কোনটা এসেছে? এসেছে যে: “আমি তোমাদের মাঝে দুটি ভারী বস্তু রেখে গেলাম, কুরআন ও আমার আহলে বাইত। এই দুটিকে আঁকড়ে ধরলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।” অথচ আমাদের কাছে কী বলা হয়? “কুরআন ও সুন্নাহ”। কেন বলা হয়? কেননা আহলে বাইতকে আঁকড়ে ধরলে ধর্মব্যবসায়ীদের ধর্মব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষ তখন জেগে উঠবে। কারবালার শোককে শক্তিতে পরিণত করে আলে সৌদের মত রাজতান্ত্রিক জুলুমবাজদেরকে ধ্বংস করে ফেলবে যে! অতএব, মুয়াবিয়া-এজিদের পথে চলো!


জানেন, কুরআনে আছে যে, আর কোনো নবী-রাসূল তাঁদের দাওয়াতের বিনিময়ে কিছু চান নাই, কেবল মুহাম্মদ (সা.) ছাড়া! হ্যাঁ, মুহাম্মদ (সা.) মানবজাতিকে যে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন, তার বিনিময়ে তিনি আমাদের কাছ থেকে একটি জিনিস দাবী করেছেন। আর তা হলো, আমরা উনার নিকটাত্বীয়দের ভালোবাসবো। একথা কুরআনে সুস্পষ্ট আছে। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা নবীজিকে আদেশ করেছেন একথা বলতে। কিন্তু হায়, সেই নবী বংশের সাথে কতই না শত্রুতা। নবীজির প্রিয় নাতির হত্যাকারী আজ জান্নাতি, জাকির নায়েক তার নামের সাথে রাদিয়াল্লাহ আনহু পড়ে! আর সেই জাকির নায়েককে প্ল্যাটফর্মে তুলে দিতে সকলে মিলে লিখছে: #SupportZakirNaik ! এই জাকির নায়েক আমাদের মুসলমানদের মধ্যে “গর্ব” প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে: তার সাথে ডিবেটে নাস্তিকরা হেরে যায়, হিন্দুরা হেরে যায়, আর আমরা খুশিতে হাত তালি দেই, বাহবা দেই। আমাদের ফিলিংস হয়, “যাক, নাস্তিকদের নাকানি চুবানি খাওয়া গেল, ব্যাটা হিন্দু নিজেই শাস্ত্র জানে না, হেরে গেল, হা হা হা।” এ-ই কি ছিল মুহাম্মদী ইসলাম?


জানেন, বিদায় হজ্জ্ব থেকে ফেরার পথে গাদীরে খুমে আল্লাহর রাসুল (সা.) ইমাম আলীর (আ.) হাত উঁচু করে ধরে বলে গেছেন: “আমি যার মওলা, অতঃপর এই আলী তাও মওলা।” আমাদের হুজুররা সেই হাদীস আমাদের থেকে গোপন করে রেখেছে, জানেন? অথচ এটা মুতাওয়াতির হাদীস, যা সর্বোচ্চ সহীহ হাদীসগুলির অন্যতম। তারা আমাদেরকে কিচ্ছু বলে না। তারা আমাদের থেকে কুরআনের আয়াত গোপন করেছে, হাদীস গোপন করেছে। আর কিতাবের কিছু অংশ প্রকাশ করা, কিছু অংশ গোপন করা, এজাতীয় কাজকে আল্লাহ বলেছেন স্বল্পমূল্যে খোদার বাণী বিক্রি করে দেয়া। স্বল্পমূল্য, অর্থাৎ দুনিয়াবী লাভ। আমরা অনেক প্রতারিত হয়েছি, অনেক। এখনও হচ্ছি, এইসব জাকির নায়েকদের দ্বারা। তারা আমাদের কাছ থেকে কত কিছু গোপন করছে! নাস্তিকদের সাথে, অন্যান্য ধর্মের মানুষের সাথে আর সাধারণ দর্শক-শ্রোতাদের সাথে ডিবেইট শো করে উনি সবার মাঝে একটা ধারণা দিচ্ছেন, উনি খুব পারদর্শী! কিন্তু কখনো বর্তমান যুগের বড় বড় আলেমদের সাথে ডিবেইট ডিসকাশানে যাবেন না, কেননা সেখানে গেলে মুহুর্তেই উনার গোমর ফাঁস হয়ে যাবে, মুখোশ উন্মোচন হয়ে যাবে। উনি না মুজতাহিদ, না মুহাদ্দিস, না ফকিহ। কেবল রেসলিং শো এর মত ইসলামিক ডিবেইট শো করেন। আর জেনেশুনে সত্য গোপন করে যান, আলে সৌদের ওহাবী-সালাফী ছায়া হিসেবে কাজ করেন। আহলে বাইতের প্রকাশ্য শত্রুতা করেন না, তবে তাদের মান মর্যাদা গোপন করেন, আহলে বাইতের অনুসরণ যে ঈমানের অংশ, সেকথা গোপন করেন। আর সেইসাথে আহলে বাইতের শত্রু জাহান্নামীদেরকে জান্নাতি বানিয়ে দেন! আমরাতো অনেক প্রতারিত হয়েছি, অনেক!


আমি জানি, খুব কমই আছেন এতসব উপস্থাপিত তথ্য যাচাই করবেন, পড়াশুনা করবেন, তারপর সপ্তাহ-মাস কিংবা বছর শেষে আমাকে এসে বলবেন, তোমার এতটুকু ভুল আর এতটুকু সঠিক ছিল। ইতিহাসগুলি বাদই দিলাম, ক’জনই বা কুরআনের আয়াতগুলি দেখবেন, যেগুলির কথা বললাম! তবুও, সত্য কথাটি রেখে গেলাম। ফেইসবুকের মত প্ল্যাটফর্মে যখনই লেখা দিই না কেন, যখনই কথা বলি না কেন, all possible reaction আসবেই। কেবল কম আর বেশি। আমার এই লেখায় যদি কারো গোঁড়ামি বৃদ্ধি পায়, তবে সে দায় ইনশাআল্লাহ আমার নয়। আল্লাহপাক তো কুরআন দিয়েও অনেককে গোমরাহ করেন, সে কথাতো তিনি স্বয়ং কুরআনে বলেছেন। বৃষ্টির পানি ফুলের বাগানে পড়ে, নর্দমাতেও পড়ে, ফুলের বাগানে পড়লে বের হয় সুঘ্রাণ, আর নর্দমাতে পড়লে বের হয় দুর্গন্ধ -- সেটা কি বৃষ্টির পানির দোষ?
আমি কিছু তথ্য রেখে গেলাম। মৃত্যুই সকল সত্যের উন্মোচনকারী, এবং আমি শান্ত হৃদয়ে সেদিকে অগ্রসর হতে প্রস্তুত, ইনশাআল্লাহ। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন।


নূরে আলম

জুলাই ১৪, ২০১৬।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

টাকার ইতিহাস, মানি মেকানিজম ও ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মহা জুলুম

ভূমিকা: জালিমের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম  (মহররম: ইনফো সিরিজ এর শেষ পোস্ট ছিল এটা। মূল সিরিজটি পড়ে আসুন ) জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাস হলো মহররম মাস। জালিমের মুখোশ উন্মোচনের মাস মহররম। জুলুমের কূটকৌশল উন্মোচনের মাস মহররম। আধুনিক সেকুলার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় লেজিসলেশান (সংসদ), আর্মড ফোর্সেস (আর্মি) ও জুডিশিয়ারি (আদালত) হলো এক মহা জুলুমের ছদ্মবেশী তিন যন্ত্র, যারা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে জুলুম টিকিয়ে রাখার জন্য। তারচেয়েও বড় জালিম হলো big corporations: বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, যারা তাবৎ দুনিয়াকে দাস বানিয়ে রেখেছে। আর এই দাসত্বের শৃঙ্খলে তারা আমাদেরকে আবদ্ধ করেছে ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মাধ্যমে: টাকা আমাদের শ্রমকে ধারণ করে, অথচ সেই টাকার মূল্য আপ-ডাউন করায় অন্যরা -- ব্যাংক ব্যবসায়ীরা! টাকা আমাদের শ্রমকে সঞ্চয় করার মাধ্যম, অথচ সেই টাকা আমরা প্রিন্ট করি না, প্রিন্ট করে (ব্যাংকের আড়ালে) কিছু ব্যবসায়ী! সেই টাকার মান কমে যাওয়া (বা বেড়ে যাওয়া) আমরা নির্ধারণ করি না -- নির্ধারণ করে ব্যাঙ্ক (ব্যবসায়ীরা)! ইমাম হুসাইনের (আ.) প্রতিবাদী চেতনাকে ধারণ করব, শোকাহত হ

ধর্মব্যবসা: মুসলমানদের হাতে ইসলাম ধ্বংসের অতীত-বর্তমান (১)

ভূমিকা যদিও পলিটিকাল-রিলিজিয়াস ইস্যুতে নিশ্ছিদ্র আর্গুমেন্ট উপস্থাপন করে আলোচনা করার অভ্যাস আমার, কিন্তু এখানে বিস্তারিত ইতিহাস তুলে ধরে আর্গুমেন্ট করার প্রথমতঃ ইচ্ছা নেই, দ্বিতীয়তঃ সময় ও সুযোগ নেই। আমি যা সত্য বলে জানি, তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি। যারা আমার উপর আস্থা রাখেন তাদের জন্য এই লেখাটি সোর্স অব ইনফরমেশান, উন্মুক্ত হৃদয়ের মানুষদের জন্য সত্য অনুসন্ধানের নতুন কিছু টপিক, আর প্রেজুডিসড ধর্মান্ধ রোগগ্রস্ত অন্তরের জন্য রোগ বৃদ্ধির উছিলা। শেষ পর্যন্ত আর্গুমেন্ট ও ডায়লগের দুয়ার উন্মুক্ত রাখার পক্ষপাতী আমি, কিন্তু সেই আর্গুমেন্ট অবশ্যই সত্য উন্মোচনের নিয়তে হওয়া উচিত, নিজের দীর্ঘদিনের লালিত বিশ্বাস ও ধ্যান ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করবার উদ্দেশ্যে নয়। মক্কা-মদীনা: মুহাম্মদ (সা.) থেকে আলে-সৌদ (৬২৯-১৯২৪) এদেশের অধিকাংশ মানুষ মক্কা-মদীনার ইতিহাস কেবল এতটুকু জানেন যে, মুহাম্মদ (সা.) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন। কিন্তু প্রায় চৌদ্দশ’ বছর আগে মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র থেকে আজকের রাজতান্ত্রিক সৌদি আরবের ইতিহাস কম মানুষই জানেন। প