চেস্টার বেনিংটন সুইসাইড করেছে দুইদিন হলো। বিখ্যাত মার্কিন রক মিউজিক ব্যান্ড Linkin Park এর গায়ক ছিল সে। গানের কথাগুলিও সে-ই লিখত। টাকা পয়সা, যশ-খ্যাতি, আরাম-আয়েস, স্ত্রী-সন্তান - কী ছিল না তার!
এতকিছু থেকেও কিছু একটা ছিল না। যে কারণে --
একটা সুইসাইড তো আর হুট করে হয় না। সাধারণতঃ দীর্ঘদিন ধরে এটা ডেভেলপ করে। একটা মানুষ মানসিকভাবে কষ্টে থাকে। বাইরে সুস্থ স্বাভাবিক থাকলেও ভিতরে ভিতরে সে ভালো থাকে না। এভাবে দিনের পর দিন। চলতে চলতে... সবারই ব্রেকিং পয়েন্ট থাকে। সেইখানে পৌঁছে গেলে অনেকে সুইসাইড করে। চেস্টার বেনিংটনের সুইসাইড শুধুমাত্র তার মৃত্যুর চিত্র তুলে ধরে না, সেইসাথে তুলে ধরে তার দীর্ঘদিনের "ভালো না থাকার" গল্প।
মাত্র দুইমাস আগে তারই বন্ধু আরেক বিখ্যাত গায়ক ক্রিস কর্নেল সুইসাইড করেছে। আর এখন চেস্টার বেনিংটন। Numb, Crawling, In the End, One Step Closer, Breaking the Habit - এসব গানের অন্তত লিরিক্স সার্চ করে পড়ে দেখবেন - যারা এসবের সাথে পরিচিত নন -- শুধু এটুকু জানার জন্যে যে, গানগুলিতে কী অনুভূতি সে ব্যক্ত করত!
এমনকি বাংলাদেশেরও - আমাদেরও ইয়াং জেনারেশান তার গানের কথার মাঝে নিজেকে প্রকাশ করতে পেরেছে, কিংবা নিজেকে খুঁজে পেয়েছে। আর সেসব গানের কথাগুলি কী? বিষণ্ণতা, রাগ, ক্ষোভ, সমাজবিরুদ্ধ ভাবনা, কষ্ট, একাকীত্ব...।
বিগত কয়েক মাসে আরো বেশ কয়েকজন আন্তর্জাতিক সেলেব্রিটির মৃত্যু/আত্মহত্যার নিউজ দেখেছি। সম্প্রতি গায়ক তাহসান আর তার স্ত্রীর ডিভোর্সের নিউজ অনেকে শেয়ার করছে। তার পরপরই এলো চেস্টার বেনিংটনের সুইসাইডের নিউজ।
দেখেন, মৃত্যুটা দুঃখজনক ব্যাপার না। মৃত্যু তো সবারই গল্পের অংশ। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এই মানুষগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ মনোকষ্টে ভুগেছে। চেস্টার হয়ত ট্রমাটাইজড হয়ে গিয়েছিল, তাহসান হয়ত হয়নি। তবুও, তাদের সংসার -- সেখানে শান্তি থাকলে নিশ্চয়ই ডিভোর্স হতো না! এইযে স্টেজ মাতানো মানুষগুলো - যাদেরকে বারবার "play" দিয়ে দেখতে দেখতে আমরা অনেক বেশি আপন করে ফেলি - যে কারণে তাদের মৃত্যুতে এত কষ্ট পাই -- সেই মানুষগুলোর অনেকেই স্টেজের পিছনে যে অত্যন্ত কষ্টের জীবন যাপন করে - বছরের পর বছর ধরে বিষণ্ণতায় ভোগে, সুইসাইড করার পরিকল্পনা করে - এবং শেষমেষ একদিন সফল হয় -- আমরা কি সেই পিছনের গল্পগুলি দেখি?
ইন ফ্যাক্ট, চেস্টার বেনিংটনের মৃত্যুতে আজকে যারা কষ্ট পাচ্ছে, ফেইসবুকে RIP লিখছে -- তারা কি এজন্যে কষ্ট পাচ্ছে যে, গায়কটা দীর্ঘদিন - বছরের পর বছর বিষণ্ণতা, অশান্তি, নেশা আর অতীত স্মৃতির ট্রমাতে ভুগছিল?
এই গায়ককে তো আমরা চোখের দশ ইঞ্চি সামনে এনে ফোনের স্ক্রিনে বারবার play দিয়ে কতই না আপন করে ফেলেছি; রাস্তায় চলতে চলতে তার গান ইয়ারফোনে বাজতে বাজতে তার কণ্ঠকে কতই না আপন করে ফেলেছি...। চেস্টার বেনিংটনের এমন "আপন" মানুষ কতজন ছিল? কোটি না হলেও কয়েক লক্ষ তো হবেই। এবং এই ভক্তরা যে আসলেই তাকে আপন করে নিয়েছিল, তা আজকে ফেইসবুক খুললেই দেখতে পাবেন - সত্যিকার কষ্ট প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দিচ্ছে তার ভক্তরা!
কিন্তু হায়রে! আমাদের মত এমন লক্ষ লক্ষ ভক্তের বদলে যদি তার একটা, জাস্ট একটা আপন মানুষ থাকত - যে সত্যিকারের আপন - যে শুধু সুইসাইডের ঘটনায় কষ্ট পেত না, বরং তার প্রতিটা খারাপ থাকার দিনের সঙ্গী হত, তার কষ্টগুলো বুঝত, তাকে প্রশান্তি এনে দিত -- আমার মনে হয় চেস্টার বেনিংটন এই সকল যশ-খ্যাতি, লক্ষ-কোটি ভক্ত আর সব টাকা-পয়সা ছেড়ে দিয়ে সেই ব্যক্তিকেই আপন করে নিত। আফসোস! কোনো কিছু দিয়েই সেই প্রশান্তি সে কিনতে পারেনি। যে কারণে আর সইতে না পেরে নিজের জীবনটাই শেষ করে দিয়েছে।
আমরা যারা শোক প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দিচ্ছি - আপনারা যারা দিচ্ছেন - তাকিয়ে দেখেন, আপনার আশেপাশে আরো অনেক চেস্টার বেনিংটন আছে। যারা তার Numb, In the End, One Step Closer ইত্যাদি গানের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে। তারাও সে গায়কের মত করেই "ভালো নাই"। একদিন দুইদিন না, দীর্ঘদিন। দীর্ঘদিন ধরে তারা ভালো নাই। এই তরুণ সমাজকে আপনারা বাঁচান। তাদের সত্যিকারের আপন হোন। যেমন আপন হলে একজন মানুষগুলোকে "খারাপ থাকা" থেকে বদলে "ভালো থাকার জগতে" নিয়ে আসা যায়। ভবিষ্যত অনেকগুলো সুইসাইড ঠেকানো যায়। আপনি চেস্টার বেনিংটনের সেরকম আপন হতে পারেননি -- দুর্ভাগ্য, পৃথিবীর কেউ-ই পারেনি -- অন্ততঃ আপনার পাশের মানুষটি, যে আজকে সেই গায়কের গান শুনছে -- তার আপন হোক। সত্যিকারের আপন।
নূরে আলম
জুলাই ২২, ২০১৭।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন