বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ সুইসাইড করে। দশ হাজার!!
এর মাঝে মেজরিটিই ইয়াং ছেলেমেয়ে। যে মানুষটা হারিয়ে গেল তো হারিয়েই গেল। দু'দিন দুঃখ প্রকাশ করে সবাই চলে যাচ্ছে।
এর মাঝে মেজরিটিই ইয়াং ছেলেমেয়ে। যে মানুষটা হারিয়ে গেল তো হারিয়েই গেল। দু'দিন দুঃখ প্রকাশ করে সবাই চলে যাচ্ছে।
ইউরোপ আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতে প্রচুর সুইসাইড হয়। বহুবছর তারা এর প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়নি। "যে মারা গেল তো গেল, আমরাতো বেঁচে আছি, ফূর্তি করছি" -- এটা ছিল তাদের মেন্টালিটি। পরবর্তীতে যখন বছর বছর পরিসংখ্যান প্রকাশ হতে শুরু করলো, তখন দেখা গেল যে সমাজের সবচেয়ে প্রোডাক্টিভ শ্রেণী, ইয়াং জেনারেশানের মাঝে সুইসাইড রেট অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে, তখন তারা বিষয়টা আমলে নিলো। কেননা, এরাই ভোগ-বিলাসের এই পশ্চিমা দুনিয়াকে সচল রাখে। পৃথিবীর প্রতিটা দেশেই ইয়াং ছেলেমেয়ে সবচে বেশি আউটপুট দেয় সমাজ / রাষ্ট্রকে। এই কারণে পশ্চিমা বিশ্ব সতর্ক হয়েছে, সুইসাইড প্রিভেনশান সেন্টার খুলেছে; "আহারে, মানুষ তো!" -- এমন কোনো মানবিকতা থেকে নয়।
পর্নোগ্রাফির মাফিয়ারা যেমন ইয়াং ছেলেমেয়েরা যেখানে জড়ো হয়, সেই জায়গায় গিয়ে হাজির হয়, তেমনি এখন সুইসাইড প্রিভেনশান সেন্টারগুলো ইয়াং ছেলেমেয়েদের পিছু নেয়ার মত করে তাদের সামনে হাজির হবার চেষ্টা করছে। সেকারণে ইন্টারনেট, ফেইসবুক -- এগুলোতে "thinking of suicide? just give us a call, we'll call you back" এই টাইপের নানান কথা দিয়ে "মানুষ বাঁচানোর" চেষ্টা করছে। কিন্তু খুব কমই কাজ দিচ্ছে।
আমি এখন এস্টোনিয়াতে। ফিনল্যান্ড, রাশিয়ার পাশে ১৩ লাখ জনসংখ্যার একটা ছোট দেশ। এখানে তেমন কোনো ক্রাইম নেই, সমস্যা একটাই, পানির চেয়ে মদ সস্তা। পার্কের বেঞ্চিতে প্রায়ই দেখি বয়স্ক লোকজন মদের বোতল হাতে বসে আছে। পাশ দিয়ে যাবার সময় তাদের দিকে তাকাই। দেখি, ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতেই বোঝা যায়, দেহ আছে, প্রাণ আছে, আত্মা নেই। নেশা সব শেষ করে দিয়েছে। কেন এমন হলো?
আর তরুণ ছেলেমেয়েরাও প্রচুর মদ খায়। রাত তিনটা চারটার সময় প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে দেখা যায় ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে। একজন আরেকজনে ধরে হাঁটছে, যেন পড়ে না যায়। টলছে। সেদিন ইউনিভার্সিটি থেকে রাতের বেলা আমরা কয়েকজন ফিরছি, বলা যায় প্রায় দৌড়েই আমাদের দিকে দুটো ছেলেমেয়ে আসলো। কেমন অস্বাভাবিকভাবে হাসছিলো তারা। বয়স ১৮-২০ হবে বড়জোর। এসে বলছে, "gimme a hug, gimme a hug" (give me a hug -- আমাকে একটু জড়িয়ে ধরো)।
আর তরুণ ছেলেমেয়েরাও প্রচুর মদ খায়। রাত তিনটা চারটার সময় প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে দেখা যায় ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে। একজন আরেকজনে ধরে হাঁটছে, যেন পড়ে না যায়। টলছে। সেদিন ইউনিভার্সিটি থেকে রাতের বেলা আমরা কয়েকজন ফিরছি, বলা যায় প্রায় দৌড়েই আমাদের দিকে দুটো ছেলেমেয়ে আসলো। কেমন অস্বাভাবিকভাবে হাসছিলো তারা। বয়স ১৮-২০ হবে বড়জোর। এসে বলছে, "gimme a hug, gimme a hug" (give me a hug -- আমাকে একটু জড়িয়ে ধরো)।
আমি একটু পা চালিয়ে মেয়েটাকে এড়িয়ে দুই কদম সামনে এলাম, ছেলেটা হাত বাড়িয়েছে, তাকে একটা hug দিলাম, তারপর তাকিয়ে একটা হাসি দিলাম। তারা দুইজন hug নিয়ে চলে গেল। এ-ই কি জীবন! প্রচণ্ড নেশা করে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা!
এদের অনেকেই নেশা করে কেবলমাত্র মস্তিষ্কের / আত্মার যেসব অনুভূতি তারা handle করতে পারে না, সেগুলিকে চাপা দিয়ে রাখার জন্য। এভাবে চাপা দিয়ে রাখতে রাখতে নিজেকে শেষ করে ফেলে। আর অনুভূতিগুলো বেশি তীব্র হলে করে সুইসাইড। এদেরকে কে একটু প্রাণের স্পর্শ দেবে, জীবনে অন্ততঃ একবারের জন্য হলেও প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে শেখাবে? কোনো সুইসাইড প্রিভেনশন সেন্টারে কাজ হবে না। কাজ হয় না বললেই চলে। সেখানে কয়েকজন সাইকোলজিস্ট সাইকিয়াট্রিস্ট এসে বসে থাকেন। তারা এক সমস্যা চাপা দিতে নতুন সমস্যার বুদ্ধি দেন। "Are you feeling depressed? Go on a vacation." -- এই টাইপের বুদ্ধি। "He/she dumped you? Maybe it's time to hang out with good old friends." এসব হলো তাদের বুদ্ধি। এক সমস্যাকে আরেক সমস্যা দিয়ে চাপা দেয়া!
ইউনিভার্সিটিতে তিন দিন ধরে ওরিয়েন্টেশান হয়েছিল। প্রথমদিনে পুলিশ, ডাক্তার, সাইকিয়াট্রিস্ট ইত্যাদি লোকজন এসে কথা বলল। স্টুডেন্ট কাউন্সেলিঙের সেই মহিলা বলল, যেকোনো সমস্যায় আমাদের সাথে কথা বলতে পারেন : রুমমেটের সাথে রিলেশান, প্রফেসরের সাথে রিলেশান, ইত্যাদি ইত্যাদি...।
বুঝলাম, এগুলো এখানে বড় ধরণের সমস্যা, সেকারণেই মেনশন করেছে।
বুঝলাম, এগুলো এখানে বড় ধরণের সমস্যা, সেকারণেই মেনশন করেছে।
আমি জানি এরা কোনো সমাধান দিতে পারে না। সমাধান দেবে কি, তারাতো নিজেরাই রোগী!
"দোস্ত আমার ভাল্লাগতেসে না, তোরা একটু বাসায় আয়।"
-- "ক্যান, তোর হাজব্যান্ড তোরে টাইম দেয় না? হা হা হা।"
কিছুদিন পর টিনএজার মেয়েটা সুইসাইড করলো। সেই, "দোস্তরা" এখন কেবলই আফসোস করে, ইশ, তখন কেন বুঝলাম না। আমার ছাত্রের কাছে শোনা এই অভিজ্ঞতা।
-- "ক্যান, তোর হাজব্যান্ড তোরে টাইম দেয় না? হা হা হা।"
কিছুদিন পর টিনএজার মেয়েটা সুইসাইড করলো। সেই, "দোস্তরা" এখন কেবলই আফসোস করে, ইশ, তখন কেন বুঝলাম না। আমার ছাত্রের কাছে শোনা এই অভিজ্ঞতা।
বাংলাদেশে গ্রামে আত্মহত্যার হার শহরের চেয়ে ১৭ গুণ বেশি। এবং সেই মানুষেরা আমাদের অধিকাংশেরই reach এর বাইরে। আমরা কী-ই বা করতে পারি তাদের জন্য?
আমাদের শহুরে ছেলেমেয়েদের সার্কেল কতটুকইবা? স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি। কয়েকশো মানুষ। অন্ততঃ তাদেরকে আমরা ভালোবাসতে পারি। তাদের জন্য কিছু করতে পারি। তাদেরকে "ভাল্লাগতেসে না" কথার জবাবে বাঁচাতে পারি।
আমাদের শহুরে ছেলেমেয়েদের সার্কেল কতটুকইবা? স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি। কয়েকশো মানুষ। অন্ততঃ তাদেরকে আমরা ভালোবাসতে পারি। তাদের জন্য কিছু করতে পারি। তাদেরকে "ভাল্লাগতেসে না" কথার জবাবে বাঁচাতে পারি।
আমি জানি, এবং আপনারাও অনেকে জানেন যে, "দোস্ত ভাল্লাগতেসে না" এই কথাটা মুখ ফুটে বলবার আগেই অনেকে দুনিয়াটা ছেড়ে যাচ্ছে। চিন্তা করে দেখেন, যে মারা যেতে চায়, সে কেন সুইসাইড প্রিভেনশান সেন্টারে কল দেবে?
যার ভিতরে অনেক অভিমান জমে আছে, সে হয়ত মরে গিয়ে সর্বোচ্চ ভালোবাসাটুকু পেতে চাইছে, সেতো কাউকেই কিছু বলবে না।
যার ভিতরে অনেক অভিমান জমে আছে, সে হয়ত মরে গিয়ে সর্বোচ্চ ভালোবাসাটুকু পেতে চাইছে, সেতো কাউকেই কিছু বলবে না।
আর সাইকিয়াট্রিস্ট, যারা "বিষণ্নতা, ডিপ্রেশান" ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন এবং এগুলোকে "মানসিক রোগ" হিসেবে আইডেন্টিফাই করেন, তারা আসলে এই ক্ষেত্রে খুব কমই সমাধান দিতে পারছেন। কেননা, দেহের রোগীকে রোগী বলা যায়, কিন্তু মনের রোগীকে রোগী বলা যায় না। আত্মার রোগীকেও মুখে বলা যায় না, তুমি রোগী। একারণেই সাইকিয়াট্রিস্টদের ট্রিটমেন্ট খুব কম কাজে আসে। তারা কিছু ওষুধ দেন, যা নার্ভকে শিথিল করে। আর হয়ত কিছু কাউন্সেলিং করেন, কিন্তু তা স্থায়ী হয় না।
কারণ এখানে দরকার পারস্পেক্টিভের চেইঞ্জ। সেটা কেবল তারাই করতে পারবে, যাদের সাথে সে সবসময় থাকে। সৎসঙ্গে সর্গবাস। আমরা চাই কি না চাই, আমরা আর দশজনের সঙ্গী। ছোট হোক, বড় হোক, এক বা একাধিক সার্কেলে চলছি। প্রভাব রাখছি, প্রভাবিতও হচ্ছি। কেবল এতটুকুই করণীয় যে, কখনো যেন মন্দ দ্বারা প্রভাবিত না হই। সত্য, সঠিক, ভালো -- এগুলি যেন জানতে পারি ও তার সাথে দৃঢ়ভাবে লেগে থাকতে পারে। দশটা মানুষের সার্কেলে প্রবেশ করে যেন তাদের মত হয়ে না যাই, বরং তারা যেন আমার কাছের মানুষ হয়ে যায়, কেননা আমি কষ্ট করে হলেও মন্দকে এড়িয়ে ভালোকে আঁকড়ে ধরে আছি -- এমন যেন হতে পারি। তখন আর কিছুই করতে হবে না -- মানুষের প্রাণের চাহিদা, আত্মার চাহিদা -- এগুলি যখন সে জানতে পারবে, তখন কেবল তাকে একটু আলো দেখিয়ে দেয়াই যথেষ্ট। কোনো সুইসাইড প্রিভেনশন সেন্টার লাগবে না, সাইকিয়াট্রিস্টও লাগবে না। তখন বহুদিন পর দেখব, আমি আজো হয়ত সেই মোমবাতির মতই জ্বলছি, কিন্তু আমার থেকে একটুখানি আগুন নিয়ে বন্ধুটি শামস হয়ে গেছে। সেই সূর্যের উষ্ণতায় প্রাণ ফিরে পাচ্ছে আরো কত মানুষ!
"All your sufferings come from desiring things that cannot be had. Stop desiring and you won't suffer." -- Mowlana Rumi
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন