সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইসলাম - আবেগ - ভাবনা

সকালে নিউজফিডে অন্ততঃ তিনটা কপি-পেস্ট পোস্ট দেখলাম, যেটার বাংলা করলে ফরম্যাট দাঁড়ায় এরকম:
"আমি ওমুক, বাড়ি ওমুক, মার্ক যাকারবার্গের কাছে অনুরোধ করছি মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি কটুক্তিকারী সকল পেইজ ফেইসবুক থেকে রিমুভ করে দিতে।" :o

ফেইসবুকের নিজস্ব কন্টেন্ট পলিসি আছে। সেই পলিসির বিরুদ্ধে গেলে কন্টেন্ট রিমুভ করে দেয় তারা। এইরকম কপি-পেস্ট পোস্ট যারা দিচ্ছেন, তারা যদি অন্ততঃ এভাবে লিখতেন যে: "প্রফেট মুহাম্মদ (সা.)-কে কটুক্তিকারী পেইজগুলি ফেইসবুকের কন্টেন্ট পলিসির এত নং ধারার অত নং উপধারার শর্ত লঙ্ঘন করছে। অতএব, তা বন্ধ করে দিন" - তাহলেও অন্ততঃ মানা যেত। অবশ্য এভাবে লিখলেও সেই পোস্ট ফেইসবুক মডারেটরস দেখবেন না, এবং এইসব পোস্ট মার্ক যাকারবার্গ বসে বসে দেখেও না - বরং কোনো পেইজের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করার অপশন আছে। সেখানে গিয়ে রিপোর্ট করে দিলেই হলো - তখন তারা চেক করে দেখবে যে ঐ কটুক্তিকারী পেইজ কোনো শর্ত ভঙ্গ করছে কিনা। তখন তারা বন্ধ করে দেবে। মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি ভালোবাসা / আবেগ থেকে অন্ততঃ এটুকু কাজতো করা যেত! কিন্তু কয়জন পেইজে গিয়ে রিপোর্ট করেছে? কিংবা এই লজিকাল চিন্তাগুলো মাথায় কাজ করেছে?
আমাদের কেবল আবেগ আছে। আর মনে করি যে, জোর গলায় মেজরিটি মানুষ দাবী তুললেই কাজ হয়ে যাবে। কেন আমরা লজিকালি, ইন্টেলেকচুয়ালি নিজেদেরকে ডিফেন্ড করছি না?

ধর্মের ব্যাপারে যে আমাদের বুদ্ধি কাজ করতে চায় না মোটেও, তার প্রমাণ হলো, পেইজ রিপোর্ট অপশনে না গিয়ে আমরা নিজেদের ওয়ালে লিখছি: "মার্ক যাকারবার্গ, আপনি দয়া করে ঐসব পেইজ বন্ধ করে দিন।" অথচ না যাকারবার্গ তা দেখবে, আর না সেটা দেখলে পেইজ বন্ধ করার অথরিটি তার আছে। সে ফেইসবুকের CEO বটে, কিন্তু এরমানে এই না যে সে চাইলেই যেকোনো পেইজ বন্ধ করে দেবে! এই কাজের জন্য আলাদা রিভিউ প্যানেল আছে। কিন্তু আমরা যে "প্রধানমন্ত্রী চাইলেই যে কাউকে চাকরি দিয়ে দিতে পারে রায় বদলে দিতে পারে" - এজাতীয় ব্যাপারে অভ্যস্ত, তাই মার্ক যাকারবার্গের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি!
(তাও আবার একজন ইহুদীর কাছে! আমাদের হৃদয়ের সমস্ত আবেগ দিয়ে কেঁদেকেটে বলছি যে প্লিজ পেইজগুলো বন্ধ করে দিন! হায় কপাল!)
...................................................................................
"বেহেশতে কি মানুষ তার দুনিয়ার জীবনের স্ত্রী-সন্তান বন্ধু-বান্ধবকে ফিরে পাবে?
বেহেশতে মানুষের যাকিছু মন চায়, তা-ই সে পাবে।"

নূহ (আ.)-কে আল্লাহ তায়ালা বলেছিলেন, "প্রত্যেক জোড়া প্রাণী ও তোমার পরিবারকে নৌকায় তুলে নাও, তাদের উপর কোনো ভয় আসবে না।" পরে মহাপ্লাবনে নূহ (আ.) এর কাফির ছেলের মৃত্যু হলে প্লাবন শেষে মাটিতে নামার পর পিতা নূহ (আ.) ফরিয়াদ করলেন, "হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমার ছেলে আমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, এবং তোমার ওয়াদা সত্য!"
আল্লাহপাক জবাবে বললেন, "নিশ্চয়ই তোমার ছেলে তোমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নয়, কেননা সে অসৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত। অতএব যে বিষয়ে জ্ঞান নেই সে বিষয়ে প্রশ্ন কোরো না..."

এই কথাগুলি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দুনিয়ার জীবনের biological son হলেও মৃত্যু-পরবর্তী জগতে পিতা-পুত্র সম্পর্ক তখনই বজায় থাকে, যখন উভয়কেই আল্লাহপাক কবুল করেন, উভয়েই সৎ কর্মশীল হয়। একইভাবে অন্যান্য সম্পর্কও।
অতএব, যে পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান, বন্ধু-বান্ধবের মায়ার বাঁধনে আমরা বাঁধা পড়ে আছি, মৃত্যুর সাথে সাথেই তা ছিন্ন হয়ে যাবে, এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বাস্তবতা (reality) আমাদের সামনে উপস্থিত হবে - তখন পরিতাপের সাথে দেখব যে, দুনিয়ার যত নোংরা অসভ্য খুনী-অপরাধী কাফির-মুশরিকদের সাথে আমাকে এক পরিবার করে দেয়া হয়েছে (যদি আল্লাহর কাছে কবুল না হই), কিংবা দেখব নবী-রাসুল, ওলী-আউলিয়াগণের সাথে আমাকে এক পরিবার করে দেয়া হয়েছে (যদি আল্লাহপাক কবুল করেন)।

যারা সত্যিকারের সাধুপুরুষ, তারা দুনিয়ার জীবনে স্ত্রী-সন্তান বন্ধু-বান্ধবকে ভালোবাসেন বটে, কিন্তু একইসাথে তাঁরা নিজেদের হৃদয়ে নবী-রাসুলকেই প্রকৃত আত্মীয়, প্রকৃত পরিবারের লোকের মত করে ভালোবাসেন, এবং সেইমত জীবন পরিচালনা করেন।

আর হ্যাঁ, বেহেশতে আল্লাহপাক মানুষের সকল ইচ্ছাই পূরণ করবেন, কিন্তু যে মানুষেরা সেখানে যেতে পারবে, তারা যে কী ধরণের ইচ্ছা করবে, সেটা চিন্তার বিষয়। আমাদের মাঝে স্বর্গের ধারণা কেবল এতটুকু দেয়া হয়েছে যে, সেখানে যা মন চায়, তা-ই পাওয়া যায়। বিচ্ছিন্নভাবে স্বর্গের ধারণা, কিংবা সেখানে "হুর" পাওয়া যাবে, ইত্যাদি ধারণা দেয়ার ফলে স্বর্গকে মনে হয় দুনিয়াবী লোভ-লালসা-ক্ষুধা আর না-পাওয়াগুলি পূরণ করার জায়গা। অথচ কেবল সেই মানুষদেরই বেহেশতে নেয়া হবে, যারা নিজের সমস্ত চাওয়া-পাওয়া, লোভ-লালসা, আশা-আকাঙ্খাকে ত্যাগ করেছেন, আর কেবলমাত্র আল্লাহপাকের সান্নিধ্য পাওয়াকেই জীবনের পরম আরাধ্য করেছেন।

আর এই বিষয়টাকেই আধ্যাত্মিক ধারায় "মৃত্যুর আগে মৃত্যু" বলে অভিহিত করা হয়। অথাৎ, জৈবিক দেহের মৃত্যুর আগেই লোভ-লালসাপূর্ণ সত্ত্বার মৃত্যু ঘটিয়ে নির্লোভ ও নির্মোহ হয়ে যাওয়া। তখন সেই ব্যক্তি আল্লাহপাকের সদা স্মরণে স্থিতিশীল এক শান্তিতে বিরাজ করেন।

আমাদের যেকোনো ধর্মীয় জিজ্ঞাসার সাথে ধর্মীয় জীবনের মূল লক্ষ্য "আল্লাহপাকের সান্নিধ্য" কিভাবে সম্পর্কযুক্ত, সেই সূত্রটি দেখাতে না পারলে ঐ ধর্মীয় জ্ঞান আধ্যাত্মিক যাত্রার পথে কাজে আসে না। এই সংযোগসূত্রটি দেখতে পারা জরুরি।

মার্চ ৩১, ২০১৭।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

টাকার ইতিহাস, মানি মেকানিজম ও ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মহা জুলুম

ভূমিকা: জালিমের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম  (মহররম: ইনফো সিরিজ এর শেষ পোস্ট ছিল এটা। মূল সিরিজটি পড়ে আসুন ) জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাস হলো মহররম মাস। জালিমের মুখোশ উন্মোচনের মাস মহররম। জুলুমের কূটকৌশল উন্মোচনের মাস মহররম। আধুনিক সেকুলার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় লেজিসলেশান (সংসদ), আর্মড ফোর্সেস (আর্মি) ও জুডিশিয়ারি (আদালত) হলো এক মহা জুলুমের ছদ্মবেশী তিন যন্ত্র, যারা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে জুলুম টিকিয়ে রাখার জন্য। তারচেয়েও বড় জালিম হলো big corporations: বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, যারা তাবৎ দুনিয়াকে দাস বানিয়ে রেখেছে। আর এই দাসত্বের শৃঙ্খলে তারা আমাদেরকে আবদ্ধ করেছে ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মাধ্যমে: টাকা আমাদের শ্রমকে ধারণ করে, অথচ সেই টাকার মূল্য আপ-ডাউন করায় অন্যরা -- ব্যাংক ব্যবসায়ীরা! টাকা আমাদের শ্রমকে সঞ্চয় করার মাধ্যম, অথচ সেই টাকা আমরা প্রিন্ট করি না, প্রিন্ট করে (ব্যাংকের আড়ালে) কিছু ব্যবসায়ী! সেই টাকার মান কমে যাওয়া (বা বেড়ে যাওয়া) আমরা নির্ধারণ করি না -- নির্ধারণ করে ব্যাঙ্ক (ব্যবসায়ীরা)! ইমাম হুসাইনের (আ.) প্রতিবাদী চেতনাকে ধারণ করব, শোকাহত হ

ধর্মব্যবসা: মুসলমানদের হাতে ইসলাম ধ্বংসের অতীত-বর্তমান (১)

ভূমিকা যদিও পলিটিকাল-রিলিজিয়াস ইস্যুতে নিশ্ছিদ্র আর্গুমেন্ট উপস্থাপন করে আলোচনা করার অভ্যাস আমার, কিন্তু এখানে বিস্তারিত ইতিহাস তুলে ধরে আর্গুমেন্ট করার প্রথমতঃ ইচ্ছা নেই, দ্বিতীয়তঃ সময় ও সুযোগ নেই। আমি যা সত্য বলে জানি, তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি। যারা আমার উপর আস্থা রাখেন তাদের জন্য এই লেখাটি সোর্স অব ইনফরমেশান, উন্মুক্ত হৃদয়ের মানুষদের জন্য সত্য অনুসন্ধানের নতুন কিছু টপিক, আর প্রেজুডিসড ধর্মান্ধ রোগগ্রস্ত অন্তরের জন্য রোগ বৃদ্ধির উছিলা। শেষ পর্যন্ত আর্গুমেন্ট ও ডায়লগের দুয়ার উন্মুক্ত রাখার পক্ষপাতী আমি, কিন্তু সেই আর্গুমেন্ট অবশ্যই সত্য উন্মোচনের নিয়তে হওয়া উচিত, নিজের দীর্ঘদিনের লালিত বিশ্বাস ও ধ্যান ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করবার উদ্দেশ্যে নয়। মক্কা-মদীনা: মুহাম্মদ (সা.) থেকে আলে-সৌদ (৬২৯-১৯২৪) এদেশের অধিকাংশ মানুষ মক্কা-মদীনার ইতিহাস কেবল এতটুকু জানেন যে, মুহাম্মদ (সা.) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন। কিন্তু প্রায় চৌদ্দশ’ বছর আগে মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র থেকে আজকের রাজতান্ত্রিক সৌদি আরবের ইতিহাস কম মানুষই জানেন। প

পিস টিভি, জাকির নায়েক ও এজিদ প্রসঙ্গ

সম্প্রতি গুলশান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। আমি তখন দিল্লীতে ছিলাম। দেশে ফিরে শুনি পিস টিভি ব্যান করা হয়েছে বাংলাদেশে, এবং তার আগে ইন্ডিয়াতে। আমার বাসায় টিভি নেই, এবং আমি জাকির নায়েকের লেকচার শুনিও না। কিংবা পিস টিভিতে যারা লেকচার দেন, বাংলা কিংবা ইংলিশ -- কোনোটাই শুনি না; প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া আমার ইসলামের বুঝ জাকির নায়েকসহ পিস টিভি ও তার বক্তাদেরকে ইন জেনারেল আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। Peace TV বন্ধ হওয়ায় এদেশে বিকৃত ইসলাম প্রসারের গতি কমলো -- এটাই আমার মনে হয়েছে। একইসাথে আমি এটাও মনে করি যে, যেই অভিযোগ পিস টিভিকে ব্যান করা হয়েছে, তা নিছক অজুহাত। জাকির নায়েক কখনো জঙ্গীবাদকে উস্কে দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। কিংবা পিস টিভির লেকচার শুনে শুনে ISIS জঙ্গীরা সন্ত্রাসী হয়েছে -- এটা নিতান্তই হাস্যকর কথা। ISIS এর ধর্মতাত্ত্বিক বেইজ সম্পর্কে মোটেও ধারণা নেই, এমন লোকের পক্ষেই কেবল ISIS এর জন্য জাকির নায়েককে দোষ দেয়া সম্ভব। একইসাথে আমি এ বিষয়েও সচেতন যে, পিস টিভি বন্ধ করা হয়েছে আমাদের সরকারের রেগুলার “ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের অংশ