ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের রাজনৈতিক কাঠামো অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য। ঠিক কোন কোন জায়গায় পাওয়ার প্লে চলে, কার ক্ষমতা কতটুকু, ইত্যাদি বুঝে ওঠা কঠিন। কেননা, সারা দুনিয়ার মধ্যে একটা ইউনিক রাষ্ট্র-পরিচালনার সিস্টেম দিয়ে গেছেন বিপ্লবের নেতা মরহুম ইমাম খোমেনী।
স্ট্রাকচারটা একটা ইনফোগ্রাফিকে দেখলে বুঝতে সুবিধা হবে। ছবিটা জুম করে বিভিন্ন অংশ এবং তীর চিহ্নগুলো দেখুন। আশা করি কয়েকবার দেখলে বোঝা যাবে।
(যারা ছবি দেখতে পাচ্ছেন না, তাদের জন্য নিচে টেক্সটগুলো দিয়ে দিলাম)
**১. ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট:
রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ। সরকারের নির্বাহী বিভাগ পরিচালনার জন্য জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। টানা চার বছর প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারেন, সর্বোচ্চ মোট ৮ বছর (যদি পুনঃনির্বাচিত হন)।
**২. ইসলামী মজলিসে শুরা (মজলিস/পার্লামেন্ট):
জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণ আইন প্রণয়ন ও আইন সংশোধন করেন।
**৩. গ্রাম/শহর কাউন্সিল:
জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে কাউন্সিলরগণ নির্বাচিত হন; এরপর কাউন্সিলরগণ মেয়র ও গভর্নর নির্বাচিত করেন।
........................................................................................
এটুকু পর্যন্ত আমরা সবাই-ই পরিচিত। কেননা, আমাদের দেশেও এমপি ইলেকশান হয়, কাউন্সিলর ইলেকশান হয়। বিশ্বের বহু দেশে প্রেসিডেন্ট ইলেকশান হয়।
তবে একটা লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হলো, দলীয় পদ্ধতির বিশেষ কোনো মর্যাদা এখানে নাই। স্বতন্ত্র্য প্রার্থীর মত করেই এমপিরা ইলেকশানে দাঁড়ান। অতএব, ধানের শীষ/ নৌকা/ দাঁড়ি পাল্লার নামে কলা গাছ দাঁড় করিয়ে দিলেও যে সে এমপি হয়ে যায় -- এমনটা ঘটা সম্ভব না। জনগণ মার্কা দেখে না, ব্যক্তিকে যাচাই করে নির্বাচিত করে। অতএব, জনগণের মতামত অনেক বেশি প্রতিফলিত হয় এমপিদের মধ্যদিয়ে।
দ্বিতীয় ব্যাপার হলো, প্রেসিডেন্টকে (ক্ষমতার দিক থেকে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী পদের সমান) নির্বাচিত করে জনগণ সরাসরি ভোট দিয়ে। এর সাথে এমপিদের কোনো সম্পর্ক নাই। অতএব, যে ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হবে, তাকে যোগ্য হতে হবে, জনগণের সামনে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে হবে। আমাদের দেশের মত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ/ বিএনপির দুইজনের একজনই হবে -- এরকম সিচুয়েশান না। অতএব, জনগণের মতামত অনেকটাই বেশি প্রতিফলিত হয় প্রেসিডেন্টের মধ্যদিয়েও, এবং এমপিদের মধ্যদিয়েও।
এ পর্যন্ত মোটামুটি বোঝা গেলেও, জটিলতা/বিশেষত্ব শুরু হয় এরপর থেকে। জনগণ কেবল তিন ধরণের ব্যক্তিকে (প্রেসিডেন্ট, এমপি, কাউন্সিলর) নির্বাচিত করে না, আরো একটি নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয়। নির্বাচিত করে। আর সেটা হলো:
..............................................................................................
**৪.বিশেষজ্ঞ পরিষদ:
জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ফকীহগণের (মুজতাহিদ আলেম) দায়িত্ব হলো সর্বোচ্চ নেতা রাহবারকে নির্বাচিত করা ও রাহবারের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা।
তো, রাহবারের কাজ তাহলে কী?
ইংলিশে লেখে Supreme Leader, ইরানিরা বলে রাহবার, বাংলায় লেখে সর্বোচ্চ নেতা। পদবী থেকেই বোঝা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট, এমপি-মন্ত্রী, সেনাপ্রধান, আদালত... সবার উপরে যিনি, তিনিই সর্বোচ্চ নেতা। রাষ্ট্রের আর সবার উপরে তাঁর পাওয়ার।
**৫. সর্বোচ্চ নেতা (রাহবার):
রাহবার তথা সর্বোচ্চ নেতার পদ হলো দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পদ, যিনি রাষ্ট্রের মূলনীতি নির্ধারণ করেন এবং সরকারের তিনটি অঙ্গকে দিকনির্দেশনা দেন।
..............................................................................................
রাষ্ট্রের আর সবার উপরে তাঁর পাওয়ার, তিনি যদি খারাপ হন? তাহলে? এখানেই বিশেষজ্ঞ পরিষদের কাজ। তাঁরা সর্বদা রাহবারের নৈতিক চরিত্র, বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক সক্ষমতার দিকে নজর রাখেন এবং যদি কখনো দেখেন যে তিনি রাহবারের গুরুদায়িত্ব পালনে অক্ষম/অযোগ্য হয়ে পড়েছেন, সাথে সাথে তাঁকে পদচ্যুত করে নতুন রাহবার নিয়োগ দেবেন বিশেষজ্ঞ পরিষদ।
অতএব, বিশেষজ্ঞ পরিষদ সরাসরি তেমন কোনো পাওয়ার প্র্যাকটিস না করলেও সর্বোচ্চ পাওয়ারফুল নেতাকে নিয়োগ/ বরখাস্ত করতে পারেন। একটা হলো প্যাসিভ সুপ্রিম পাওয়ার। আর রাহবারের পদ হলো অ্যাকটিভ সুপ্রিম পাওয়ার।
বোঝাই যাচ্ছে, এটা খুবই সেনসিটিভ জায়গায়। এখানে চেকিং দেয়ার উপায় কী? সেটা নিয়ে একটু পরে আলোচনা করছি। আগে রাষ্ট্রের বাকী অঙ্গগুলো দেখে নিই:
...........................................................................................
**৬. সর্বোচ্চ নেতার উপদেষ্টামণ্ডলী:
পররাষ্ট্রনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ নেতাকে পরামর্শ দেন।
**৭. অভিভাবক পরিষদ:
১২ সদস্যবিশিষ্ট অভিভাক পরিষদের ৬ জন ফকিহ (মুজতাহিদ আলেম)-কে নিয়োগ দেন সর্বোচ্চ নেতা, অপর ৬ জন আইন বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ দেয় পার্লামেন্ট। অভিভাবক পরিষদের কাজ প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থীদের যোগ্যতা যাচাই করা।
**৮. বিচার বিভাগ:
সর্বোচ্চ নেতা (রাহবার) বিচার বিভাগের চেয়ারম্যানকে নিয়োগ দেন, যার দায়িত্ব হলো বিচার মন্ত্রণালয়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা। সরকারের বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মাঝে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে বিচার মন্ত্রণালয়।
**৯. ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সশস্ত্র বাহিনী:
সশস্ত্র বাহিনীগুলোর কমান্ডার-ইন-চিফ হলেন রাহবার (সর্বোচ্চ নেতা)।
তিনি বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীর (আইআরজিসি, আর্মি ও পুলিশের) কমান্ডার নিয়োগ দেন।
**১০. মন্ত্রী পরিষদ:
প্রেসিডেন্ট মন্ত্রী নিয়োগ দেন। তবে প্রেসিডেন্টের মনোনীত প্রার্থীদেরকে আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ-সদস্যের হাঁ-ভোট পেতে হয়।
(এখানে একটা লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হলো, আমাদের দেশে দলের ভিতরে মন্ত্রীত্ব নিয়ে যেমন মারামারি হয়, এবং অযোগ্য লোক পার্টি পলিটিক্স করে মন্ত্রী হয়ে যায়, ইরানে সেটার সুযোগ নেই। প্রেসিডেন্ট চাইলে কোনো প্রফেসর/ এক্সপার্টকে মন্ত্রী হিসেবে সাজেস্ট করেন, অধিকাংস সংসদ সদস্য ওকে করলে তখনই সে মন্ত্রী হতে পারে। হাসান রুহানী সরকারের ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট কয়েকবার প্রার্থী নিয়ে এসেছেন, তারপর শেষমেষ এমপিরা তাকে ওকে করেছে! আমাদের দেশে এমনটা ভাবা যায়?
আবার দেখুন, এমপিদের তো প্রেসিডেন্টের কাছে কোনো ঠেকা নেই যে, প্রেসিডেন্ট নাখোশ হলে দলের মার্কায় নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে না -- সেহেতু এমপিরাও স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারে। আবার, এমপিরাও স্বেচ্ছাচারিতা করার সুযোগ নাই, কারণ জনগণ মার্কা দেখে ভোট দেয় না, ভোট দেয় ব্যক্তি দেখে। বেশি উল্টাপাল্টা করলে আর জীবনেও সে জনগণের ভোট পাবে না।)
..............................................................................................
আচ্ছা, এবার দেখেন, রাহবারের পদ কতদূর বিস্তৃত।
১. সকল সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার তিনি সম্পূর্ণ নিজে নিয়োগ দেন (অতএব, সেনা অভ্যুত্থান বা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমে সেনাবাহিনী যে স্বৈরাচারী হয়ে উঠবে, সে সুযোগ নাই)। - এখানে রাহবারের Active power.
২. অভিভাবক পরিষদের যাচাইসাপেক্ষে প্রেসিডেন্ট ইলেকশানে দাঁড়াতে পারে প্রার্থীরা, আর সেই পরিষদেরও ১২ জনের ৬ জনকে সরাসরি রাহবার নিয়োগ দেন (অতএব, রাহবারের একেবারে বিপরীত লোক প্রেসিডেন্ট হওয়ার চান্স নাই)। - এখানে রাহবারের Passive power.
৩. বিচার বিভাগের চেয়ারম্যানকে সরাসরি রাহবার নিজে নিয়োগ দেন (অতএব, স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট আদালতকে ব্যবহার করে শত্রু দমন করবে - তেমন চান্স নেই)। - এখানে রাহবারের Active power.
৪. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে রাহবার সরাসরি নিয়োগ দেন, যার অধীনে থাকে পুলিশ বাহিনী, আর সেই পুলিশ বাহিনীর প্রধানকেও তিনিই নিয়োগ দেন (ফলে প্রেসিডেন্ট মনোনয়নের জায়গায় রাহবার প্যাসিভ পাওয়ার চর্চা করা সত্ত্বেও যদি স্বৈরাচারী মনোভাবের কোনো প্রেসিডেন্ট ঘটনাক্রমে ক্ষমতায় চলেও আসে, সে চাইলেই পুলিশ বাহিনীকে নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারবে না, কেননা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও পুলিশ বাহিনীর প্রধানকে রাহবার নিজে নিয়োগ দেন)। - এখানে রাহবারের Active power.
৫. রাহবারের অনুমতি ছাড়া যুদ্ধ ঘোষণা কিংবা running কোনো যুদ্ধে সন্ধিচুক্তি করা যায় না (অতএব, কোনো প্রেসিডেন্ট যে স্বৈরাচারী হয়ে উঠবে, যুদ্ধবাজ হয়ে উঠবে, তার সুযোগ নেই)। - এখানে রাহবারের Active power.
৬. এছাড়াও রাষ্ট্রীয় রেডিও-টেলিভিশন সংস্থার প্রধানকে রাহবার মনোনীত করেন (অতএব, স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট নিজের ক্ষমতার স্বার্থে স্বেচ্ছাচারীর মত মিডিয়াকে ব্যবহার করবে - এমনটা ঘটার সুযোগ নাই)। - এখানে রাহবারের Active power.
(এবং আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাহবারের প্রভাব রয়েছে। সর্বোপরি, গোটা ইরানের জনগণের মাঝে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।)
..............................................................................................
তো, দেখা যাচ্ছে যে, রাহবারের এই সাংবিধানিক পদটি বরং কোনো প্রেসিডেন্ট বা সেনাপ্রধানের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠাকে প্রতিহত করে। অতএব, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ।
কিন্তু -- এত ক্ষমতাশালী একটি পদে যিনি আসবেন, তাকে কারা নির্বাচিত করছে?
ঐযে, ৮৮ জন আলেমের "বিশেষজ্ঞ পরিষদ"। এবং তাঁরা সবাই সর্বোচ্চ পর্যায়ের আলেম (ফকিহ-মুজতাহিদ)। বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানীও তেমন একজন আলেম, বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য। মরহুম হুজ্জাতুল ইসলাম হাশেমী রাফসানজানিও বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য ছিলেন।
এবং এই আলেমগণকে নির্বাচিত করেন জনগণ, প্রতি ৮ বছর পরপর। আর আলেমগণের নির্বাচন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মত করে "দশ টাকা চালের" প্রতিশ্রুতি দেখে হয় না। সেটা হয় একজন আলেমের তাক্বওয়া দেখে, দ্বীনদারী দেখে।
অতএব, শেষমেষ ক্ষমতা সেই জনগণের হাতেই! কিন্তু সবক্ষেত্রে আলেমগণের দ্বারা নির্বাচিত "রাহবার" এর দিক নির্দেশনা, মনোনয়ন, কমবেশী নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি থাকায় ইরান শুধুমাত্র প্রজাতন্ত্র নয়, বরং "ইসলামী প্রজাতন্ত্র"।
শেষকথা: ব্যক্তি যাচাই করে এমপি, প্রেসিডেন্ট, কাউন্সিলর ও বিশেষজ্ঞ পরিষদ সদস্য নির্বাচন করে থাকে ইরানের জনগণ, যারা দেশের নানান অঙ্গ পরিচালনা করেন। এটা যদি গণতন্ত্র না হয়, তবে কোনটা গণতন্ত্র?
ইসলাম ও গণতন্ত্রের উপযুক্ত সমন্ব ঘটেছে ইরানের শাসনব্যবস্থায়। আর এর সবই সম্ভব হয়েছে বিপ্লবের মহান আধ্যাত্মিক নেতা মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) এর দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞার ফলে।
আফসোস! বিশ্বের বুকে একমাত্র এই ইসলামী রাষ্ট্রটিকে মেজরিটি মুসলমান প্রেজুডিসের কারণে চিনলো না ও সমর্থন করতে পারলো না। যাহোক, সে ভিন্ন গল্প।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন