১. 'কুরআন' হলো আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে একটি একক অনুভূতি / ভাব (sense)। এই ধাপে কুরআনের সংরক্ষণ বা বিকৃতি -- ইত্যাদি কোনো প্রশ্নই আসে না। অতএব, সংরক্ষণ পদ্ধতিরও প্রশ্ন আসে না।
২. অতঃপর এই অনুভূতি আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ (সা.) এর হৃদয়ে 'নাযিল' করেছেন, সম্পূর্ণটা, একত্রে। প্রশ্ন হলো, এই স্তরে তা সংরক্ষিত থাকবে কিনা? এবং সংরক্ষণের পদ্ধতি কী?
এর উত্তর সংক্ষেপে দিলে তা অসম্পূর্ণ হবে, কেননা নূরে মুহাম্মদীর (সা.) দৃষ্টিকোণ এক্ষেত্রে অপরিহার্য। তবে সংক্ষেপে বললে, মুহাম্মদ (সা.) নিষ্পাপ ও নির্ভুল তো বটেই, ব্যক্তিসত্তার দিক থেকে তিনি এত উচ্চ স্তরের যে, সেখানেও আসলে সংরক্ষণ ও বিকৃতি ইত্যাদি প্রশ্নই আসে না। অতএব, তিনি যা ধারণ করে আছেন, তা অপরিবর্তিত ও সংরক্ষিত রূপে আছে এবং থাকবেই।
৩. অতঃপর আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছাক্রমে বিভিন্ন সময়ে এই 'একক অনুভূতি', (যা আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত, যাকে কুরআন বলা হয়, তা) থেকে মুহাম্মদ (সা.) বিভিন্ন অনুভূতি (ভাব - sense) আরবি ভাষায় মুখে প্রকাশ করেছেন, যেটাকে আমরা সাধারণভাবে 'নাযিল' হওয়া বলে থাকি। এইযে তা মানুষের ভাষায় প্রকাশ হয়ে পড়লো, এবার এই স্তরে সংরক্ষণের প্রশ্ন আসছে। এবং এই স্তরে এসে আমরা কুরআনকে এক সুবিশাল 'কথামালা' বলতে পারি, যদিও এটি আসলে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত 'একক অনুভূতি', এবং সেই বিচারে এটা পৃথিবীর অন্য কোনো গ্রন্থ, যা মানুষ রচনা করে থাকে, তার সাথে একই ক্যাটেগরিতে বিবেচ্য নয়।
৪. তাহলে, প্রথম স্তর -- আল্লাহ তায়ালা, দ্বিতীয় স্তর -- মুহাম্মদ (সা.) এর হৃদয়, তৃতীয় স্তর -- আরবি ভাষা। আর এই তৃতীয় স্তরে কুরআনটাকে আমরা জাহেরি বা প্রকাশ্য রূপে পাই। এই স্তরে সংরক্ষণ পদ্ধতি কী?
তা আমরা সবাই জানি। প্রথম থেকেই তা মানব মস্তিষ্কে সংরক্ষিত হয়ে আসছে।
পরবর্তীতে এখন তা কাগজের বই আকারে এবং ডিজিটাল ফরম্যাটে সর্বত্র অ্যাভাইলেবল, কিন্তু এগুলি এই তৃতীয় স্তরে সংরক্ষণের কোনো পদ্ধতি নয়, বরং মানুষের কাছে 'মানব-মস্তিষ্কে সংরক্ষিত কথামালা' পৌঁছে দেবার উপায় মাত্র। অতএব, সারা পৃথিবীর সকল কাগজ পুড়ে গেলে, সার্ভার ধ্বংস হয়ে গেলে বা সকল টেকনোলজি ধ্বংস হয়ে গেলেও যতদিন 'মানুষ' টিকে আছে, ততদিন মানব মস্তিষ্কে এইভাবে কুরআন সংরক্ষিত থাকবে। তবে কাগজেই পড়ুন, কি মস্তিষ্কেই সংরক্ষণ করুন কি হাফেজে কুরআনের তেলাওয়াত থেকেই শুনুন -- সবসময় মনে রাখতে হবে যে, এটি তৃতীয় স্তর, এবং এটি মানব-রচিত 'বই' এর মত একই ক্যাটেগরির জিনিস নয়, বরং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসুল (সা.) এর মাধ্যম হয়ে আগত একটি 'ভাব'। অতএব, সেই মূল 'ভাব' ও তার উৎসের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
.....................................................
আপনি-আমি 'কুরআন' নামে একটা বই পাচ্ছি। আবার 'হাদীস' নামে বই পাচ্ছি। তারপর কেউ হচ্ছে আহলে কুরআন, কেউবা আহলে হাদীস, কেউবা দুইটাই, কিন্তু অসংখ্য দল-উপদল...। যাহোক, সেটা বিষয় না, আমি এখন কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করব।
১. নাস্তিকদের কাছে "কুরআন আল্লাহর বাণী" প্রমাণ করার জন্য অনেকে যে পুরো কুরআনের বিভিন্ন অংশ এনে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, কিংবা আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে মিলিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন -- তাদের কাছে প্রশ্ন হলো --
প্রথম মুসলমানেরা কি এভাবেই কুরআনকে মেনে নিয়েছিল? যখন কেবল ৫টি আয়াত, ১০টি আয়াত, কিংবা একটা দুইটা সূরা নাযিল হয়েছে, কুরআন নাযিলের প্রথম বছরগুলোতে, যখন গোটা কুরআনের ৫০%ও নাযিল হয়ে সারে নাই -- ঐ যুগের মুলমানরা কিভাবে কুরআনকে আল্লাহর বাণী হিসেবে চিনেছিল? তাদের কাছে তো মলাটবদ্ধ 'কুরআন' নামে ১১৪টা সূরা ছিল না যে, মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতো, আল্লাহর গ্রন্থ কিনা?
২. প্রথম যুগের মুসলমানদের কাছে 'হাদীস', সিহাহ সিত্তাহ, বুখারী-মুসলিম ইত্যাদি মলাটবদ্ধ কিতাবও ছিল না। অতএব, শুধু কুরআন নিয়ে আহলে কুরান/কুরানিস্ট, বা শুধু বুখারী-মুসলিম নিয়ে আহলে হাদীস -- ইত্যাদি ইস্যু তাদের হতো না, হয়নি।
.......................................................
৩. লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, আল্লাহ তায়ালার সুন্নাত হলো, তিনি মানুষের হেদায়েতের জন্য 'ব্যক্তি' প্রেরণ করেছেন, নিষ্প্রাণ বই নয়। কুরানিস্টরা এই জিনিসটা ভুলে যান, এবং ভুলে যাই আমরা সাধারণ মুসলমানেরাও। নিষ্প্রাণ কাগজের বইয়ে ধর্মের কথা পড়ে আমরা তাতে বন্দী হয়ে পড়ি। অথচ... আল্লাহ তায়ালা বরাবরই নবী/রাসুল প্রেরণ করেছেন মানুষের হেদায়েতের জন্য, কিতাব নয়। কেউ কেউ কিতাব এনেছেন, কেউ কেউ আনেন নাই।
৪. অতএব, "আমার জন্য শুধু কুরআনই যথেষ্ট, মুহাম্মদ (সা.) এর কাজ ছিল ডাকপিয়নের মত সেটা কেবল এনে দেয়া" -- এধরণের বোকামী কথায় নিজেকে বন্দী করে ফেলবেন না। কিংবা -- কুরআন ও সিহাহ সিত্তাহ-ই যথেষ্ট -- এরধরণের কথায়ও নিজেকে বন্দী করে ফেলবেন না। নিষ্প্রাণ কাগজের কুরআন আঁকড়ে ধরে কুরানিস্টই হন, কি নিষ্প্রাণ কাগজের হাদীস ধরে আহলে হাদীস হন, কিংবা কুরআন + ছয়টা নিষ্প্রাণ গ্রন্থ আঁকড়ে ধরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতই হন --
৫. ভুলে যাচ্ছেন যে, আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক হেদায়েতের যে সুন্নাত, তার বাইরে থেকে যাচ্ছেন আপনি।
৬. কাগজ-কলম কি কেবল এই আধুনিক যুগের জিনিস?
মানবজাতি লিখিত আকারে তাদের জ্ঞান সংরক্ষণ করে আসছে হাজার বছর ধরে, কুরআনেরও আগ থেকে। আল্লাহ তায়ালা আসমান থেকে মলাটবদ্ধ কিতাব হাজির করতে পারতেন -- এবং মুশরিকরা সেটা বলেছিলও বটে -- কিন্তু আল্লাহ তায়ালার সুন্নত সেটা নয়।
খুব কঠিন স্টিলের তৈরী পৃষ্ঠায় খোদাই করা আরবি হরফের একটা বই আকাশ থেকে এসে পড়ত, তারপর সেটাকে কেউ ধ্বংস করতে পারত না কিছু দিয়ে, আর সেটা পড়ে পড়ে যারা হেদায়েত নেবার নিয়ে যেত -- নাকি?
এখন যেভাবে আমরা অনেকেই, কিংবা কুরানিস্ট যারা -- শুধু একটি বই পড়ে 'হেদায়েতপ্রাপ্ত' হবার চিন্তা করছেন?
৭. অতএব, শুধু মলাটবদ্ধ কুরআনই মানেন, কি শুধু মলাটবদ্ধ হাদীসই মানেন, কি দুইটা মলাটবদ্ধ বই-ই মানেন -- তিন গ্রুপই আসলে একই ক্যাটেগরিতে আছে: নিষ্প্রাণ কাগজের বইয়ে বন্দী।
বারবার চিন্তা করুন, বারবার লক্ষ করুন, আল্লাহপাক সবসময় মানুষ পাঠিয়েছেন, কাগজের বই নয়। আপনি সেরকম মানুষ খুঁজুন (তার মানে বলছি না যে একজন নবী আবিষ্কার করবেন)। এমন মানুষ খুঁজুন, যিনি আপনাকে সত্যের সাথে সংযুক্ত করিয়ে দেবেন। যিনি আপনাকে কখনো কুরআনের বাণী পড়ে শুনাবেন, আবার একইসাথে আপনার জীবনেরও বিভিন্ন দিককে গাইড করবেন -- ঠিক যেন মুহাম্মদ (সা.) এরই উত্তরসূরী! ঠিক যেন সেই সময়ের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি!
এমন একজন ইনসানে কামেল এর কাছ থেকে হেদায়েত সন্ধান করুন।
....................................................
তবে একটা প্রশ্ন র'য়েই গেল। কুরানিস্টদের যুক্তি: আল্লাহ বলেছেন এই কুরআনকে বোঝার জন্য সহজ করে দিয়েছি, কুরআনই সকল কিছুর বর্ণনা -- তাহলে হাদীসের আর দরকার নেই।
তাদের এই কথার জবাব আছে। এই মলাটবদ্ধ কুরআনের পাশাপাশি মলাটবদ্ধ হাদীস, যা রাসুল (সা.) এর জীবনচরিত -- তারও প্রয়োজন আছে। হ্যাঁ, তা অবশ্যই যাচাইসাপেক্ষে গ্রহণ করতে হবে, এবং সহীহ' বললেই চোখ বুঁজে মেনে নেয়া যাবে না, সর্বদা যাচাইসাপেক্ষ থাকবে -- কিন্তু রাসুল (সা.) এর গোটা জীবনচরিত জানার প্রয়োজন আছে।
কী আশ্চর্য ব্যাপার যে, আল্লাহ তায়ালা কুরআনের ভিতরে মুহাম্মদ (সা.) এর সম্পর্কে যতটুকু যা বলেছেন, তা-ই যদি যথেষ্ট হতো, এবং যথেষ্ট হতো সেইসাথে আল্লাহপাকের বক্তব্য -- তাহলে আলাদাভাবে নবী প্রেরণেরই কী দরকার ছিল! একটা বই আকাশ থেকে নাযিল করে তার ভিতরে 'উত্তম চরিত্রের গুণাবলী' লিখে দিলেই তো হতো? যেটা পড়ে পড়ে কুরানিস্টসহ বিশ্বের সকল মানুষ নিজেদের চরিত্র সংশোধন করে নিত??
কিন্তু আল্লাহ তায়ালা 'মানুষ' প্রেরণ করেছেন। এটাই তাঁর সুন্নত। কাজী নজরুলের সেই কথা -- "মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি কোনো মানুষ।"
আফসোস! বহু মুসলমান আজ সেই কিতাব আঁকড়ে ধরতে গিয়ে মানুষটাকেই ফেলে দিচ্ছে!
..............................................
আরো একটা কথা র'য়েই গেল। কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ব্যবহার করে যে কুরানিস্টরা দাবী করে -- "রাসুল (সা.) এর কথা-কর্ম আলাদাভাবে জানার প্রয়োজন নেই, শুধু কুরআনই যথেষ্ট", সেগুলির জবাবও কুরআনের ভিতর থেকে দেয়া আবশ্যক। কেননা, এক্ষেত্রে তারা কোট মাইনিং ফ্যালাসি করছে, এবং সুবিধামত আয়াত তুলে নিয়ে নিজের মতের সপক্ষে পিলার দাঁড় করাচ্ছে। সে বিষয়ে আরেকদিন আলোচনা করা যাবে। আপাততঃ জেনে রাখেন যে, মুশরিকরাও বলত, "একটা মানুষের (নবীর) কী দরকার, আকাশ থেকে একটা কিতাব এসে পড়লেই তো হত, তা স্টাডি করে আমরা হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়ে যেতাম?" আর আজকে অনেক মুসলমান সেটাই বলছে: "এই কিতাবই যথেষ্ট, আর কিছু দরকার নেই।" যেমনটা একজন বলেছিল রাসুল (সা.) এর মৃত্যুশয্যায়: "আমাদের জন্য কিতাবুল্লাহ-ই যথেষ্ট, কাগজ-কলমে আলাদা কিছু লেখার দরকার নেই হেদায়েতের জন্য।"
শয়তান তো আল্লাহর তাওহীদ সম্পর্কে জানত। সে আল্লাহকে মানতে রাজি ছিল, কিন্তু 'নবীকে' (আদম(আ.)-কে) নয়। আজ অনেক মুসলমান একইভাবে আল্লাহর কথা (কুরআন) মানতে রাজি, কিন্তু সেইসাথে নবীর (সা.) কথা-কর্ম (হাদীস) মানতে রাজি নয়। আফসোস!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন