সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আবেগভিত্তিক বনাম তথ্যভিত্তিক অবস্থান


অধিকাংশ মানুষই আবেগভিত্তিক অবস্থান গ্রহণ করে থাকেন। নিউজিল্যান্ডে এক সন্ত্রাসী নামাজরত মুসল্লিদেরকে গুলি করে শহীদ করেছে, এটা হলো তথ্য। আবেগভিত্তিক অবস্থান গ্রহণ করে বহু মানুষ অনলাইনে বলছে যে, এখন কেন পশ্চিমা মিডিয়া উক্ত হামলাকারীকে সন্ত্রাসী জঙ্গী ইত্যাদি বলছে না?

অথচ একটু চিন্তা করলেই কতগুলো বিষয় ফুটে উঠবে, এবং আপনি তথ্যভিত্তিক শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করতে পারবেন। যেমন:
জঙ্গী, মৌলবাদী, টেরোরিস্ট ইত্যাদি শব্দকে একটি বিশেষ পারিভাষিক রূপ দিয়েছে শয়তানি (পশ্চিমা ও অন্যান্য) মিডিয়া: আর তা হলো, দাড়ি-টুপি পরিহিত সশস্ত্র মুসলিম। অথচ পৃথিবীর প্রতিটা মানুষেরই আত্মরক্ষার্থে সশস্ত্র হবার অধিকার আছে, এবং যুদ্ধে-শান্তিতে সদা-সর্বদা সশস্ত্র সামরিক প্রস্তুতি মুসলমানদের উপর ফরজ (কুরআন)।

কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়া দীর্ঘদিন ধরে উক্তি শব্দগুলোকে একটি বিশেষ পারিভাষিক রূপ দিয়েছে; এবং ততদিন আমরা চুপ ছিলাম। এখন আমরা আবার তাদেরকে দোষারোপ করছি যে, কেন তারা উক্ত শব্দগুলো এই মসজিদে হামলাকারীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে না?

দেখুন, এর সবটাই তথ্যসন্ত্রাস। এইযে জঙ্গি, মৌলবাদী, জিহাদী, জিহাদী বই, ইত্যাদি শব্দকে যে মুসলিমবিরোধী বিশেষ স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছিল শুরুতে, সেটাই একটা জুলুম। এখন সেই এই জুলুম তারা কেন করছে না আরেকজনের ক্ষেত্রে, তাই বলছি আমরা?

মোদ্দা কথা, মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে প্যাটার্নে তথ্যসন্ত্রাস চালানো হয়েছে, আমরা এখন চাইছি সেই একই তথ্যসন্ত্রাস ঐ লোকটার বিরুদ্ধও চালানো হোক?
আমরা কী চাইছি?
কাদের কাছে চাইছি?

এগুলো হলো তথ্যভিত্তিক সুচিন্তিত অবস্থান।

আর আবেগভিত্তিক অবস্থান এর বিপরীত।

একইভাবে দেখুন, সুচতুর পলিটিশিয়ান তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সাথে সাথে বক্তব্য দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করার সুযোগ লুফে নিযেছে, এবং আবেগী মুসলমানের তা গণহারে শেয়ার করছে। অথচ প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ব্যাপারে যদি কেউ তথ্যভিত্তিক অবস্থান গ্রহণ করতে চায়, তাহলে তাকে কয়েক ঘন্টা হোমওয়ার্ক করতে হবে: এরদোয়ানের এক যুগ+ শাসনামলের ইতিহাস ঘাঁটতে হবে। এবং তখনই সে দেখতে পাবে ইজরাইলের সাথে কিভাবে বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক শনৈঃ শনৈঃ বৃদ্ধি করেছেন এরদোয়ান। অতএব, সে মুসলমানের বন্ধু কেউ নয়, বরং ক্ষমতালোভী একজন সুচতুর রাজনীতিবিদ, স্বৈরশাসক। এটা হলো তথ্যভিত্তিক অবস্থান। এই অবস্থান গ্রহণ করতে হলে আপনাকে হোমওয়ার্ক করতে হবে।

ফেইসবুকে আমার এক জুনিয়র বন্ধু ইনবক্সে আমাকে বলছে, তার এক নাস্তিক বন্ধু জিজ্ঞাসা করেছে যে, আল্লাহ যদি আগে থেকেই ভাগ্যে লিখে থাকে যে ওমুক খুন ধর্ষণ করবে, তারপর সে সেটা করে, তাহলে তাকে জাহান্নামের আগুনে পুড়ানো কি অন্যায় নয়?
আমি বললাম, যুক্তি তো ঠিক, কিন্তু প্রশ্ন হলো, আল্লাহ আগে থেকে সবার ভাগ্য লিখে রেখেছেন -- এটা আল্লাহ বলেছেন কিনা?
তখন সেই বন্ধুটি উল্টা আমাকে জিজ্ঞাসা করছে, কেন, আল্লাহ কি জানতেন না মানুষ এত অন্যায় করবে?
আমি জবাব দিলাম, আল্লাহর ব্যাপারে আল্লাহকে জিজ্ঞাসা করাই ভাল।
ও বলল, মানুষ উত্তর দিতে পারে না?
বললাম, কেন আল্লাহর কাছ থেকে উত্তর সন্ধান না করে আমরা মানুষের কাছ থেকে উত্তর সন্ধান করছি?

কিন্তু ঐযে, আল্লাহর কাছ থেকে উত্তর পেতে হলেতো তাঁর কাছে যেতে হবে। সেটাতো এক সুবিশাল আধ্যাত্মিক যাত্রা। স্রষ্টা, সৃষ্টি, ধর্ম এসব বিষয়ে জানতে অত দীর্ঘ যাত্রা করে তথ্যভিত্তিক অবস্থান গ্রহণ করবে কে?

অতএব, আল্লাহর জায়গায় আল্লাহ আছেন। আর তাঁর সম্পর্কে মানুষের কাছে দুই মিনিটে দুই টুকরা কথা জিজ্ঞাসা করে শুনে নিয়ে আবেগী মানুষেরা দৌড়াদৌড়ি মারামারি করছে।
………………………………………………

আমি ৯৫% নাস্তিকদের দেশে থাকি, এবং এরাও মুসলিম বিদ্বেষী। আজকে এক ভাই আফসোস করে বলছিলেন, "ভাই আমি আজকে জুমার নামাজে যাইনি।" বুঝলাম নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার কারণে।

আমি অবশ্য এদেশে জুমার নামাজে যাই না।
কেন?
এখন আপনি চাইলে আবেগভিত্তিক অবস্থান গ্রহণ করে আমাকে "তিন জুম্মা মিস" ফতোয়া দিয়ে মুসলিম রেজিস্ট্রি থেকে নাম কাটিয়ে দিতে পারেন। অথবা যদি বিনয়ী, দয়ালু ও ধৈর্য্যশীল হন, তবে আসুন, তথ্যভিত্তিক অবস্থান গ্রহণের জ্ঞানের পথটা দেখিয়ে দিই। সেজন্যে আমার যাত্রাপথের সঙ্গী হতে হবে: দুই মিনিটে খোঁচা দিয়ে দৌড় দেয়া যাবে না।

আমি আবেগহীন ও আবেগবিরোধী মানুষ নই। কেবল এতটুকু চাই যে আমাদের আবেগগুলোর গোড়ায় যেন তথ্যভিত্তিক ও জ্ঞানভিত্তিক দৃঢ় ভিত্তি থাকে।
…………………………………………………………………

আমাদের নিউজিল্যান্ডের শহীদ ভাই-বোনদের জন্য সবাই আগে-পিছে দরুদ শরীফসহ কমপক্ষে একবার সূরা ফাতেহা পাঠ করে এইভাবে দোয়া করবেন যে: হে আল্লাহ, এই ফাতেহা পাঠের সওয়াব আমাদের এই শহীদ ভাই-বোনদের রুহের উপর পৌঁছে দাও।

আসসালামু আলাইকুম।

নূরে আলম
১৬ মার্চ ২০১৯, এস্তোনিয়া

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

টাকার ইতিহাস, মানি মেকানিজম ও ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মহা জুলুম

ভূমিকা: জালিমের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম  (মহররম: ইনফো সিরিজ এর শেষ পোস্ট ছিল এটা। মূল সিরিজটি পড়ে আসুন ) জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাস হলো মহররম মাস। জালিমের মুখোশ উন্মোচনের মাস মহররম। জুলুমের কূটকৌশল উন্মোচনের মাস মহররম। আধুনিক সেকুলার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় লেজিসলেশান (সংসদ), আর্মড ফোর্সেস (আর্মি) ও জুডিশিয়ারি (আদালত) হলো এক মহা জুলুমের ছদ্মবেশী তিন যন্ত্র, যারা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে জুলুম টিকিয়ে রাখার জন্য। তারচেয়েও বড় জালিম হলো big corporations: বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, যারা তাবৎ দুনিয়াকে দাস বানিয়ে রেখেছে। আর এই দাসত্বের শৃঙ্খলে তারা আমাদেরকে আবদ্ধ করেছে ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মাধ্যমে: টাকা আমাদের শ্রমকে ধারণ করে, অথচ সেই টাকার মূল্য আপ-ডাউন করায় অন্যরা -- ব্যাংক ব্যবসায়ীরা! টাকা আমাদের শ্রমকে সঞ্চয় করার মাধ্যম, অথচ সেই টাকা আমরা প্রিন্ট করি না, প্রিন্ট করে (ব্যাংকের আড়ালে) কিছু ব্যবসায়ী! সেই টাকার মান কমে যাওয়া (বা বেড়ে যাওয়া) আমরা নির্ধারণ করি না -- নির্ধারণ করে ব্যাঙ্ক (ব্যবসায়ীরা)! ইমাম হুসাইনের (আ.) প্রতিবাদী চেতনাকে ধারণ করব, শোকাহত হ

ধর্মব্যবসা: মুসলমানদের হাতে ইসলাম ধ্বংসের অতীত-বর্তমান (১)

ভূমিকা যদিও পলিটিকাল-রিলিজিয়াস ইস্যুতে নিশ্ছিদ্র আর্গুমেন্ট উপস্থাপন করে আলোচনা করার অভ্যাস আমার, কিন্তু এখানে বিস্তারিত ইতিহাস তুলে ধরে আর্গুমেন্ট করার প্রথমতঃ ইচ্ছা নেই, দ্বিতীয়তঃ সময় ও সুযোগ নেই। আমি যা সত্য বলে জানি, তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি। যারা আমার উপর আস্থা রাখেন তাদের জন্য এই লেখাটি সোর্স অব ইনফরমেশান, উন্মুক্ত হৃদয়ের মানুষদের জন্য সত্য অনুসন্ধানের নতুন কিছু টপিক, আর প্রেজুডিসড ধর্মান্ধ রোগগ্রস্ত অন্তরের জন্য রোগ বৃদ্ধির উছিলা। শেষ পর্যন্ত আর্গুমেন্ট ও ডায়লগের দুয়ার উন্মুক্ত রাখার পক্ষপাতী আমি, কিন্তু সেই আর্গুমেন্ট অবশ্যই সত্য উন্মোচনের নিয়তে হওয়া উচিত, নিজের দীর্ঘদিনের লালিত বিশ্বাস ও ধ্যান ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করবার উদ্দেশ্যে নয়। মক্কা-মদীনা: মুহাম্মদ (সা.) থেকে আলে-সৌদ (৬২৯-১৯২৪) এদেশের অধিকাংশ মানুষ মক্কা-মদীনার ইতিহাস কেবল এতটুকু জানেন যে, মুহাম্মদ (সা.) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন। কিন্তু প্রায় চৌদ্দশ’ বছর আগে মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র থেকে আজকের রাজতান্ত্রিক সৌদি আরবের ইতিহাস কম মানুষই জানেন। প

পিস টিভি, জাকির নায়েক ও এজিদ প্রসঙ্গ

সম্প্রতি গুলশান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। আমি তখন দিল্লীতে ছিলাম। দেশে ফিরে শুনি পিস টিভি ব্যান করা হয়েছে বাংলাদেশে, এবং তার আগে ইন্ডিয়াতে। আমার বাসায় টিভি নেই, এবং আমি জাকির নায়েকের লেকচার শুনিও না। কিংবা পিস টিভিতে যারা লেকচার দেন, বাংলা কিংবা ইংলিশ -- কোনোটাই শুনি না; প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া আমার ইসলামের বুঝ জাকির নায়েকসহ পিস টিভি ও তার বক্তাদেরকে ইন জেনারেল আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। Peace TV বন্ধ হওয়ায় এদেশে বিকৃত ইসলাম প্রসারের গতি কমলো -- এটাই আমার মনে হয়েছে। একইসাথে আমি এটাও মনে করি যে, যেই অভিযোগ পিস টিভিকে ব্যান করা হয়েছে, তা নিছক অজুহাত। জাকির নায়েক কখনো জঙ্গীবাদকে উস্কে দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। কিংবা পিস টিভির লেকচার শুনে শুনে ISIS জঙ্গীরা সন্ত্রাসী হয়েছে -- এটা নিতান্তই হাস্যকর কথা। ISIS এর ধর্মতাত্ত্বিক বেইজ সম্পর্কে মোটেও ধারণা নেই, এমন লোকের পক্ষেই কেবল ISIS এর জন্য জাকির নায়েককে দোষ দেয়া সম্ভব। একইসাথে আমি এ বিষয়েও সচেতন যে, পিস টিভি বন্ধ করা হয়েছে আমাদের সরকারের রেগুলার “ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের অংশ