সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বর্তমান সময়ের ইসলাম সংক্রান্ত সমস্যার উপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত -- ৩. ধর্মীয় রিসার্চ সেন্টারের গুরুত্ব

পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় রিসার্চ সেন্টার না থাকার ফলে একদিকে যেমন ধর্মীয় দল / মতগুলোর সংশোধন-উন্নয়ন ঘটছে না, অপরদিকে তেমনি বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত মুসলমানেরা ঐক্যবদ্ধও হতে পারছে না। মুসলিম সমাজ হলো জ্ঞানভিত্তিক সমাজ। এখানে গোত্র প্রথাও নেই যে বিভিন্ন গ্রুপ আলাদা আলাদা গোত্র হিসেবে নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। আদর্শ মুসলিম উম্মাহ গোটা বিশ্বব্যাপী একই মূলনীতিতে চলবে, এবং তাদের মধ্যে পরস্পরবিরোধিতা থাকবে না। এটা নিশ্চিত করতে হলে ধর্মীয় রিসার্চ সেন্টারের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় রিসার্চ সেন্টার থাকলে সেখানে নিয়মিত জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে প্রতিটি গ্রুপই যেমন নিজেদের ভুল-ত্রুটির সংশোধন করতে পারবে, অপরদিকে তেমনি সকল গ্রুপের সর্বোচ্চ জ্ঞানী ব্যক্তিরা রিসার্চ সেন্টারে একত্রিত হয়ে পরস্পর জ্ঞান বিনিময়ের মাধ্যমে ঐক্যের দিকে পৌঁছাতে পারবে। অতঃপর এই রিসার্চ সেন্টার থেকে যেসকল দিক-নির্দেশনা আসবে, মুসলিম জনগণ সেটা মেনে চলবে। রাসূলের (সা.) অনুপস্থিতিতে আলেম সমাজের কর্মকাণ্ড এভাবেই পরিচালনা করা প্রয়োজন। কিন্তু তা না করে যদি প্রতিটি গ্রুপ তাদের নিজস্ব মতবাদ / মতামত নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে, পরস্পরের সাথে জ্ঞান-বিনিময় না করে, এবং নিজেদের চিন্তাধারাকে শতভাগ সঠিক বলে ধরে নিয়ে প্রচার-প্রসার করতে থাকে, তাহলে যা ঘটবে তা হলো, সময়ের সাথে সাথে গ্রুপগুলো আকারেই কেবল বাড়বে, কিন্তু তাদের ভুল-ভ্রান্তিগুলো রয়েই যাবে, এবং বিভিন্ন গ্রুপের মাঝে দ্বন্দ্ব-সংঘাতেরও নিরসন কখনো হবে না।

মুসলিম মিল্লাত কিভাবে ঐক্যবদ্ধ হবে, যখন তাদের নেতারা (আলেম সমাজ) ঐক্যবদ্ধ নন? আর আলেম সমাজের এই ঐক্য হতে হবে জ্ঞানগত ঐক্য। সেজন্যে একটি মুসলিম ভুখণ্ডের সকল আলেমকে এক প্ল্যাটফর্মে আসতে হবে। একই প্ল্যাটফর্মে এসে পরস্পর জ্ঞান-বিনিময় করতে হবে। অতঃপর নিজেদের ভুলগুলো সংস্কার করতে হবে, সংশোধন-উন্নয়ন করতে হবে। আর এটাকেই আমি বলছি "কমপ্লিট রিলিজিয়াস রিসার্চ সেন্টার"। এধরণের রিলিজিয়াস রিসার্চ সেন্টারই হবে সকল ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের উৎস। ধর্মীয় নেতৃত্বও এখান থেকেই আসতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের মুসলিম সমাজে জ্ঞান অর্জনের চেয়ে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড করার উপরই জোর দেয়া হয় বেশি। অথচ ইলম (knowledge) বিহীন আমল (practice) কোনোই গুরুত্ব বহন করে না। আর ইলম ছাড়া যারা আমল করতে যায়, স্বাভাবিকভাবেই তারা ভুল আমল করবে। যদি এমন হতো যে, প্রতিটা ইসলামী দল / মতেরই নেতৃত্ব একটি রিসার্চ সেন্টারে নিয়মিত একত্রিত হন, তাহলে আমরা কারো মাঝে ভুল দেখলে সেটা ঐখানে গিয়ে পেশ করতে পারতাম। কিন্তু ইসলামের নামে তৈরী হওয়া বিভিন্ন দল / গ্রুপগুলোর নেতারা নিজেদের অনুসারীদের কাছ থেকেই এজাতীয় কথা গ্রহণ করে না, আর অন্য গ্রুপের কাছ থেকে নিজের ভুল শোনার তো প্রশ্নই আসে না। অতএব, সংশোধন ও ঐক্য আসবে কিভাবে? প্রতিটা গ্রুপই নিজেদের কলেবর বৃদ্ধির প্রতিযোগীতায় ব্যস্ত, অথচ ঐক্যের দিকে কারোরই নজর নেই। মুসলিম সমাজের এই জ্ঞানগত ঐক্যের জন্য জ্ঞানকেন্দ্র, অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় রিসার্চ সেন্টার অপরিহার্য।

এখন, ইসলাম নিয়ে জ্ঞান অর্জনের পূর্বশর্ত যে জ্ঞানতত্ত্বের (Epistemology) পড়াশুনা, তা আলেমসমাজকে কিভাবে বুঝানো সম্ভব? "আলেমসমাজ" বলেইতো আসলে কিছু নেই। কোনো ইস্যুতে "আলেমসমাজের কাছে গিয়েছিলাম" কথাটাই বলা সম্ভব নয়, বরং বলা যেতে পারে যে, ওমুক হুজুর আর ঐ হুজুরের শত্রুর কাছে গিয়েছিলাম ইস্যুটা নিয়ে। আমাদের বাস্তবতাটা এতই করুণ! মুসলিম সমাজে যদি কোনো পাপ কাজের প্রচলন দেখি, তবে সমাধানের জন্য কার কাছে যাবো? আলেমসমাজ বলে তো কোনো ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্মই নেই! অতএব, যারা ইসলাম নিয়ে স্বাধীন জ্ঞানচর্চা করছে ও বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করছে, তারা অসহায়ের মত আশেপাশের দুয়েকজন মানুষকে বিচ্ছিন্নভাবে সতর্ক-সংশোধনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, গোড়ায় গিয়ে যে সমাধান করবে, সেই গোড়ায় (আলেমসমাজের কাছে) যেতে পারছে না। আর বিভিন্ন নেতৃত্বের কাছে গেলেও, রিসার্চারের ন্যায় মনোভাব না থাকায় তারা নিজেদের ভুল স্বীকার করতে কিংবা অন্য কোনো চিন্তা সম্পর্কে স্টাডি করতেও রাজী হন না।

ইসলামের নামে সমাজে নানান ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড চলছে। এগুলো নেতাবিহীন নয়; অবশ্যই ইসলামের নামে এসব কর্মকাণ্ড বিভিন্ন নেতৃত্বের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। ইসলামবিরোধী এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হলে ও সঠিক ইসলামের প্রচার করতে হলে সেইসব ধর্মীয় নেতৃত্বের সংশোধন প্রয়োজন। সেই নেতাদের সংশোধনের জন্য, সকল ধর্মীয় নেতৃত্বকে একই প্ল্যাটফর্মে আনার জন্য, ঐক্য সৃষ্টির জন্য ও সংস্কার-উন্নয়নের জন্য কমপ্লিট রিলিজিয়াস রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, যেখানে সকল ধর্মীয় নেতৃত্বের মতবিনিময়, জ্ঞানবিনিময় ও সাহায্য-সহযোগীতা, সংস্কার-উন্নয়ন ইত্যাদি ঘটবে। অতঃপর বিভিন্ন দেশের রিসার্চ সেন্টারগুলোর মাঝে বড় পরিসরে জ্ঞান-বিনিময় হলে বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে, এবং এইরূপ জ্ঞানগত ঐক্যের মাধ্যমেই গোটা দুনিয়ার মুসলিম উম্মাহর একই পতাকাতলে আসা সম্ভব হবে।


রিলিজিয়াস রিসার্চ সেন্টার না থাকার ফলে দেখা যায় যে, কোনো ব্যক্তি আজীবন ইসলামের সংকীর্ণ একটি গণ্ডিতেই জ্ঞানচর্চা চালিয়ে গিয়েছে। অথচ হয়তো সে যে ধারায় পড়াশুনা করেছে, তার ভিত্তিই ভুল ছিলো! কিংবা সে সঠিক পদ্ধতিে জ্ঞান অর্জন করে নাই। শুধু ইসলামের বিভিন্ন ধারা নয়, অন্যান্য ধর্ম, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, যুক্তিশাস্ত্র ইত্যাদি সকল প্রাসঙ্গিক স্টাডি টপিকের সম্পর্কে মানুষ জানতে পারবে রিসার্চ সেন্টারের কাছে এসেই। শুধু একটি ধারায় জ্ঞানচর্চার যে সমস্যা, তা রিসার্চ সেন্টার ব্যতিরেকে দূর করা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন গ্রুপ নিজেদের ধারার বইপত্রই পড়ে থাকে, এমনকি বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যেও অন্য ধারার বইপত্র পড়ে না। ফলস্বরূপ সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে থাকার কারণে ভুল-ভ্রান্তির সংশোধন ঘটে না, অন্যান্য ধারা থেকে সঠিক জিনিসটাও গ্রহণ করা হয়ে ওঠে না। সকল ধরণের জ্ঞানগত বাধা (barrier) অতিক্রমকারী পূর্ণাঙ্গ ধর্মতত্ত্বকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা তাই খুবই জরুরি।

পরবর্তী পোস্ট : দ্বীনি নেতৃত্বের ন্যুনতম যোগ্যতা

আলোচিত বিষয়সমূহ



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

টাকার ইতিহাস, মানি মেকানিজম ও ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মহা জুলুম

ভূমিকা: জালিমের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম  (মহররম: ইনফো সিরিজ এর শেষ পোস্ট ছিল এটা। মূল সিরিজটি পড়ে আসুন ) জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাস হলো মহররম মাস। জালিমের মুখোশ উন্মোচনের মাস মহররম। জুলুমের কূটকৌশল উন্মোচনের মাস মহররম। আধুনিক সেকুলার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় লেজিসলেশান (সংসদ), আর্মড ফোর্সেস (আর্মি) ও জুডিশিয়ারি (আদালত) হলো এক মহা জুলুমের ছদ্মবেশী তিন যন্ত্র, যারা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে জুলুম টিকিয়ে রাখার জন্য। তারচেয়েও বড় জালিম হলো big corporations: বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, যারা তাবৎ দুনিয়াকে দাস বানিয়ে রেখেছে। আর এই দাসত্বের শৃঙ্খলে তারা আমাদেরকে আবদ্ধ করেছে ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মাধ্যমে: টাকা আমাদের শ্রমকে ধারণ করে, অথচ সেই টাকার মূল্য আপ-ডাউন করায় অন্যরা -- ব্যাংক ব্যবসায়ীরা! টাকা আমাদের শ্রমকে সঞ্চয় করার মাধ্যম, অথচ সেই টাকা আমরা প্রিন্ট করি না, প্রিন্ট করে (ব্যাংকের আড়ালে) কিছু ব্যবসায়ী! সেই টাকার মান কমে যাওয়া (বা বেড়ে যাওয়া) আমরা নির্ধারণ করি না -- নির্ধারণ করে ব্যাঙ্ক (ব্যবসায়ীরা)! ইমাম হুসাইনের (আ.) প্রতিবাদী চেতনাকে ধারণ করব, শোকাহত হ

ধর্মব্যবসা: মুসলমানদের হাতে ইসলাম ধ্বংসের অতীত-বর্তমান (১)

ভূমিকা যদিও পলিটিকাল-রিলিজিয়াস ইস্যুতে নিশ্ছিদ্র আর্গুমেন্ট উপস্থাপন করে আলোচনা করার অভ্যাস আমার, কিন্তু এখানে বিস্তারিত ইতিহাস তুলে ধরে আর্গুমেন্ট করার প্রথমতঃ ইচ্ছা নেই, দ্বিতীয়তঃ সময় ও সুযোগ নেই। আমি যা সত্য বলে জানি, তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি। যারা আমার উপর আস্থা রাখেন তাদের জন্য এই লেখাটি সোর্স অব ইনফরমেশান, উন্মুক্ত হৃদয়ের মানুষদের জন্য সত্য অনুসন্ধানের নতুন কিছু টপিক, আর প্রেজুডিসড ধর্মান্ধ রোগগ্রস্ত অন্তরের জন্য রোগ বৃদ্ধির উছিলা। শেষ পর্যন্ত আর্গুমেন্ট ও ডায়লগের দুয়ার উন্মুক্ত রাখার পক্ষপাতী আমি, কিন্তু সেই আর্গুমেন্ট অবশ্যই সত্য উন্মোচনের নিয়তে হওয়া উচিত, নিজের দীর্ঘদিনের লালিত বিশ্বাস ও ধ্যান ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করবার উদ্দেশ্যে নয়। মক্কা-মদীনা: মুহাম্মদ (সা.) থেকে আলে-সৌদ (৬২৯-১৯২৪) এদেশের অধিকাংশ মানুষ মক্কা-মদীনার ইতিহাস কেবল এতটুকু জানেন যে, মুহাম্মদ (সা.) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন। কিন্তু প্রায় চৌদ্দশ’ বছর আগে মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র থেকে আজকের রাজতান্ত্রিক সৌদি আরবের ইতিহাস কম মানুষই জানেন। প

পিস টিভি, জাকির নায়েক ও এজিদ প্রসঙ্গ

সম্প্রতি গুলশান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। আমি তখন দিল্লীতে ছিলাম। দেশে ফিরে শুনি পিস টিভি ব্যান করা হয়েছে বাংলাদেশে, এবং তার আগে ইন্ডিয়াতে। আমার বাসায় টিভি নেই, এবং আমি জাকির নায়েকের লেকচার শুনিও না। কিংবা পিস টিভিতে যারা লেকচার দেন, বাংলা কিংবা ইংলিশ -- কোনোটাই শুনি না; প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া আমার ইসলামের বুঝ জাকির নায়েকসহ পিস টিভি ও তার বক্তাদেরকে ইন জেনারেল আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। Peace TV বন্ধ হওয়ায় এদেশে বিকৃত ইসলাম প্রসারের গতি কমলো -- এটাই আমার মনে হয়েছে। একইসাথে আমি এটাও মনে করি যে, যেই অভিযোগ পিস টিভিকে ব্যান করা হয়েছে, তা নিছক অজুহাত। জাকির নায়েক কখনো জঙ্গীবাদকে উস্কে দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। কিংবা পিস টিভির লেকচার শুনে শুনে ISIS জঙ্গীরা সন্ত্রাসী হয়েছে -- এটা নিতান্তই হাস্যকর কথা। ISIS এর ধর্মতাত্ত্বিক বেইজ সম্পর্কে মোটেও ধারণা নেই, এমন লোকের পক্ষেই কেবল ISIS এর জন্য জাকির নায়েককে দোষ দেয়া সম্ভব। একইসাথে আমি এ বিষয়েও সচেতন যে, পিস টিভি বন্ধ করা হয়েছে আমাদের সরকারের রেগুলার “ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের অংশ