বর্তমান সময়ের ইসলাম সংক্রান্ত সমস্যার উপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত -- ২. জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতি নির্ধারণ না করে ধর্মীয় পড়াশুনার সমস্যা
জ্ঞান,
জ্ঞান অর্জনের
পদ্ধতি, জ্ঞানের
উৎস, জ্ঞানের
প্রয়োজনীয়তা, জ্ঞানের
প্রয়োগক্ষেত্র ইত্যাদি হলো
জ্ঞানতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়।
কোনো বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের
আগে, হোক
সেটা ধর্মীয় বা অন্য যেকোনো
জ্ঞান, জ্ঞানতত্ত্ব
নিয়ে চিন্তা করা উচিত। আমি
যখন "ইসলামী
জ্ঞান" অর্জন
করবো, তার
আগে জানতে হবে, "জ্ঞান"
অর্জনের
উপায় কী কী। সেটা জানার পর
"ইসলামী
জ্ঞান" অর্জনের
পদ্ধতি কী, তা
নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এরপর যখন আমি জ্ঞান অর্জনের
সঠিক পন্থা নির্ধারণ করে
ফেললাম, তখন
সে পদ্ধতি ব্যবহার করে আমি
পরিশ্রম অনুযায়ী ফল পাবো।
নয়তো দেখা যাবে যে, অনেক
পরিশ্রম করার পরও আসলে কোনোই
জ্ঞান অর্জন হয় নাই, কিংবা
খুব সীমিত জ্ঞান অর্জন হয়েছে।
ইসলামী জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে
জ্ঞানতত্ত্বকে এড়িয়ে যাবার
ভয়াবহতা একটু পরেই আলোচনা
করছি। তার আগে একটা উদাহরণ
দেয়া যেতে পারে।
ইউনিভার্সিটিতে
অনেক ছেলে-মেয়েকে
দেখেছি, তারা
পড়াশুনার পিছনে প্রচুর শ্রম
দিয়ে থাকে। কিন্তু অনার্স
লেভেলে পড়াশুনার মাধ্যম হলো
ইংরেজি, অথচ
ইংরেজিতে বেশিরভাগের অবস্থাই
শোচনীয়। এমনও ছাত্র আছে যে,
১২ ক্লাস
ইংরেজি পড়ে ও পাশ করে এসে
ইউনিভার্সিটিতে প্রবেশ করেছে,
অথচ এক পৃষ্ঠা
ইংরেজি লিখতে দিলে একটিও সঠিক
বাক্য লিখতে পারে না। ইউনিভার্সিটি
অনেক উপরের স্তর। এর আগের
স্তরগুলোতেই তার ইংরেজি শিক্ষা
করা দরকার ছিলো। জ্ঞান সম্পূর্ণ
না হওয়া সত্ত্বেও সে স্তরগুলো
পার করে এসেছে, এবং
এখন এসে মহা সমস্যায় পড়েছে।
এখন তার সমস্ত বই, পরীক্ষার
খাতা, অ্যাপ্লিকেশান
– সবই ইংরেজিতে করতে হচ্ছে,
এমনকি
ক্ষেত্রবিশেষে কথাও ইংরেজিতে
বলতে হচ্ছে। এদিকে সাফল্যের
সাথে SSC-HSC পাশ
করে আসা ছাত্র এটাও মেনে নিতে
পারছে না যে, ইংরেজিতে
সে আসলে ক্লাস ফাইভ লেভেলের
যোগ্যতাও রাখে না।
এখন,
কম্পিউটার
এঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পদ্ধতি
কী? প্রোগ্রামিঙের
জ্ঞান অর্জনের নির্দিষ্ট
পদ্ধতি আছে। কিন্তু সে পদ্ধতি
জানার আগে ঐ ছাত্রের জানা
দরকার ভাষা শিক্ষা করার পদ্ধতি।
নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে,
ইংরেজি ভাষা
শেখার পদ্ধতি। এখন সে যদি এই
কথাটি বুঝতে পারে তো ভালো,
নয়তো সে
ইংরজির জ্ঞান ছাড়া যদি
প্রোগ্রামিঙের জ্ঞান অর্জনের
সঠিক পদ্ধতিে পরিশ্রমও করে,
তবুও সে আসলে
তেমন কিছুই পারবে না। কোনো
বইয়ের কোনো কথাই তার বোধগম্য
হবে না। ঘন্টার পর ঘন্টা
কম্পিউটার কিংবা বইয়ের সাথে
যুদ্ধ করেও কাঙ্খিত ফল আসবে
না। কিন্তু যদি সে এক্ষেত্রে
ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব বুঝতে
পারে, এবং
প্রথমে ইংরেজি শেখার উদ্যোগ
নেয়, তাহলে
সাফল্য আসতে পারে। এখন,
ইংরেজি শেখার
পদ্ধতি হিসেবে সে বন্ধুর
পরামর্শক্রমে ইংরেজি মুভি
দেখতে শুরু করলো। কিন্তু হয়তো
অ্যাকশনধর্মী সেসব মুভিতে
কথা বলতে আছে শুধু গালিগালাজ।
অতএব, ভুল
পদ্ধতিতে ইংরেজি শিক্ষা করার
কারণে এখন তার অবস্থা "গালি
দিয়া সব গদ্যে পদ্যে বিদ্যা
করিছে জাহির”। এভাবে বহু ঘন্টা
ব্যয় করেও তার জ্ঞান অর্জন
ঠিকমতো হলো না, কারণ
সঠিক পদ্ধতি নির্ধারণ করতে
সে ব্যর্থ হয়েছে।
ইসলামী
জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে
সচেতনভাবে জ্ঞান অর্জনের
পদ্ধতি নির্ধারণ না করে ধর্মীয়
জ্ঞানের মহাসমুদ্রে ডুব দিলে
দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি বরণ
করতে হবে। ইসলামী জ্ঞান অর্জনের
পদ্ধতি নির্ধারণ না করে জ্ঞান
অর্জনের সমস্যা কেমন হতে পারে?
যেমন,
নিচের
আর্গুমেন্ট :
"আল্লাহ
পরম জ্ঞানী; তাহলে
আমি জান্নাতে যাবো না দোযখে
যাবো, তা-ও
কি আল্লাহ জানেন? আর
আল্লাহ যদি আগে থেকেই তা জানেন,
তাহলে
তো সেটা আমার কপালেই লেখা আছে,
আমি শত
চেষ্টা করেও ভালো মানুষ হতে
পারবো না, জান্নাতে
যেতে পারবো না।"
কুরআনে
আল্লাহকে পরম জ্ঞানী বলে
উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু
কুরআনের তাৎপর্য গ্রহণের
সঠিক পদ্ধতি, অর্থাৎ,
কুরআনের
জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতি নির্ধারণ
না করে কেউ যদি একটিমাত্র
বাক্য পড়ে, যেখানে
আল্লাহকে পরম জ্ঞানী বলা
হয়েছে, তারপর
মনে মনে উপরের আর্গুমেন্ট
করে, তাহলে
সে নিশ্চিত ভুলের মধ্যে পড়লো।
এবং এই ভুল একজন দুইজন না,
অসংখ্য মানুষ
করেছে, করে
আসছে, এবং
কোটি কোটি মুসলমানকে শিক্ষা
দিয়ে আসছে যে, “ভাগ্যের
লিখন, না
যায় খণ্ডন”, "ভাগ্যেই
সবকিছু লেখা থাকে”,
ইত্যাদি।
অথচ এগুলো সুস্পষ্টরূপে
ভ্রান্ত ধারণা। এই ভ্রান্ত
ধারণা থেকে হতাশাবাদেরও
সূত্রপাত হয়।
একইভাবে,
কুরআনের
তাৎপর্য গ্রহণের সঠিক পদ্ধতি
নির্ধারণ না করে কুরআনের এই
কথাটা যদি কেউ পড়ে : "মানুষ
তা-ই
পায়, যা
সে করে"; এবং
তারপর ধারণা করে যে,
"আল্লাহর
কাছে প্রার্থনা করার প্রয়োজন
নেই, বরং
মানুষ কর্ম করলেই ফল পাবে”,
তখন সে
নিশ্চিতভাবেই ভুলের মধ্যে
পড়লো। এরকম ভ্রান্ত ধারণা
মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ
করার পর একটি গ্রুপ সম্পূর্ণ
ছেড়ে না দিলেও প্রার্থনা,
দোয়া-দরুদ
ইত্যাদির গুরুত্বকে খাটো করে
দেখছে ও দেখানোর চেষ্টা করছে।
জিহাদ
(প্রচেষ্টা),
কিতাল (হত্যা),
রাষ্ট্র,
শুরা (পরামর্শ),
হালাল,
হারাম,
আল্লাহর
রজ্জু, উলিল-আমর
ইত্যাদি অসংখ্য বিষয়ে বহু
পরস্পরবিরোধী মতের উদ্ভব
ঘটেছে সঠিক পদ্ধতিতে কুরআনের
তাৎপর্য গ্রহণ না করার ফলে।
অথচ কুরআনের জ্ঞান গ্রহণের
আগে ঐশী কিতাবের
অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য,
এবং তারও
পূর্বে স্রষ্টার
অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য,
নবী
চেনার উপায়, আখিরাত
ইত্যাদি প্রসঙ্গে জ্ঞান অর্জন
করতে হবে। নয়তো কেউ ঐশী কিতাবকে
পরিবর্তনযোগ্য মনে করে যতই
কুরআন পড়ুক, নিশ্চিন্ত
হয়ে আস্থা রাখতে পারবে না
কখনোই। কেউ যদি আল্লাহর শরীর
আছে বলে ধারণা করে, তাহলে
"আল্লাহর
রজ্জু”কে সে বস্তুগত জিনিস
বলে মনে করতেই পারে।
কেউ
যদি প্রতিদিন মানুষের লেখা
ধর্মীয় বই পড়ে, এভাবে
সারা জীবনে অসংখ্য মানব-রচিত
ধর্মীয় বই পড়ে, অথচ
আল্লাহর কিতাব, কুরআন
না পড়ে, তবে
তার সারাজীবনের শ্রম প্রায়
পুরোটাই বৃথা। অথচ ধর্মীয়
জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতি নিয়ে
চিন্তা করলে সে প্রথমেই ঐশী
কিতাবের সন্ধান করতো,
এবং কুরআন
পাঠে মনোযোগী হতো। হাদীস
যাচাই-বাছাইয়ের
পদ্ধতি না জেনে "সহীহ
হাদীস" বলে
প্রচারিত যেকোনো কথাকেই যদি
কেউ বিশ্বাস করে, তবে
সে নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে,
অপরকেও
ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সে যদি
নবীর পাপমুক্ততার ব্যাপারে
নিশ্চিত না হয়, তাহলে
মিথ্যা হাদিস সে সহজেই গ্রহণ
করবে, ইত্যাদি।
যদিও
জ্ঞানতত্ত্ব
নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ
এখানে নেই, তবুও
আশা করি এতটুকু বুঝানো গিয়েছে
যে, ধর্মীয়
জ্ঞানচর্চার জন্য জ্ঞান
অর্জনের পদ্ধতি, অর্থাৎ
জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে আলাদাভাবে
পড়াশুনা ও গবেষণা করা অপরিহার্য।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন