সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইসলাম - শিরক এর উপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা


দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ইসলামের মৌলিক বিষয়ে উপযুক্ত ধারণার অভাবে মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তির শেষ নেই। এত অসংখ্য ভ্রান্তি আছে যে তার তালিকা করতে গেলে কয়েকটি এনসাইক্লোপিডিয়া হয়ে যাবে। এতসব ভ্রান্তি দেখে ইসলামপ্রিয় যেকোনো মানুষের মনেই প্রশ্ন জাগে : কিভাবে, কোন অ্যাপ্রোচ গ্রহণ করলে এতসব ভ্রান্তি দূর করা সম্ভব ? এক্ষেত্রে এটা খুবই অবাস্তববাদী অ্যপ্রোচ হবে যে, আমরা প্রতিটা ভুল ধারণা নিয়ে একটি করে লেকচার দেবো / আর্টিকেল লিখবো, এবং যুক্তি দেখিয়ে সেগুলোকে ভুল প্রমাণিত করে সঠিক জিনিসটা শিক্ষা দেবো। এভাবে করলে কোন মানুষই মুসলমানদের সকল ভুলের উত্তর দেয়া শেষ করতে পারবে না। যেমনিভাবে এটা ভুল অ্যাপ্রোচ যে আমরা আল্লাহ-রাসূল নিয়ে নাস্তিকদের সকল অপযুক্তি ও কটুক্তির জবাব দেবো। বরং সঠিক অ্যাপ্রোচ হলো মৌলিক বিষয়ের সংক্ষিপ্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত জ্ঞান বিতরণ করা, যেনো সেই জ্ঞান ব্যবহার করে মুসলমানেরা ভুল এড়িয়ে জীবন চলতে পারে।

অনলাইনে দেখবেন নাস্তিকতার যুক্তিখণ্ডন করে অসংখ্য আর্টিকেল, ঘন্টার পর ঘন্টা লেকচার; রাসুলুল্লাহর উপর নাস্তিকদের অপবাদের যুক্তিখণ্ডন, বিশাল বিশাল লেখা, যুক্তি....। আপনি যদি নাস্তিকদের প্রচলিত সমস্ত যুক্তির জবাবও দিয়ে দেন, পরদিনই দেখা যাবে কোনো নাস্তিক আরেকটা নতুন অপযুক্তি নিয়ে এসেছে। যাহোক, তা সত্ত্বেও আমরা অনেকেই এই ভুল অ্যাপ্রোচ গ্রহণ করে নাস্তিকদের জবাব দিয়ে যাচ্ছি। এবং অনেকটা একইভাবে আমাদের মুসলমানদের আভ্যন্তরীন সমস্যাগুলোর সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ যেনো অনেকটা এমন ব্যাপার যে : জনগণকে রাষ্ট্রের আইনগুলো শিখিয়ে না দিয়ে অসংখ্য পুলিশ নিয়োগ দেয়া, যেনো আইন বিরুদ্ধ কাজ দেখলেই গ্রেফতার করা যায়। অথচ জনগণকে যদি ঐ রাষ্ট্রের আইনগুলো আগেভাগেই জানিয়ে দেয়া হতো, তাহলে হয়তো সে অপরাধই করতো না।

দেখুন, কুরআন কিন্তু সেই অ্যাপ্রোচ-ই গ্রহণ করেছে। নাস্তিকতার সমস্ত অপযুক্তিকে কুরআন খণ্ডন করছে এভাবে :
“তারা কি কোনোকিছু (কোনো সৃষ্টি-উৎস/ সৃষ্টিকর্তা) ছাড়াই (নিজে নিজেই/ শূন্য থেকেই) সৃষ্ট হয়েছে, নাকি তারা (নিজেরাই নিজেদের) সৃষ্টিকর্তা?” (সূরা আত্ব-তূর, ৫২:৩৫)
ব্যস, আর দরকার নেই নাস্তিকদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা ডিবেইট কিংবা লেকচার। এই একটি বাক্যেই আল্লাহ তায়ালা নাস্তিকতাকে অসার প্রমাণ করে দিয়েছেন।
“যদি আসমান ও জমীনে আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য ইলাহ থাকতো, তবে উভয়েই ধ্বংস হয়ে যেতো। অতএব, তারা যা বলে, তা থেকে আরশের অধিপতি আল্লাহ পবিত্র।” (সূরা আল আম্বিয়া, ২১:২২)
ব্যস, আর দরকার নেই হিন্দুদের কোটি কোটি দেবতা কিংবা খ্রিষ্টানদের ত্রিত্ববাদের যুক্তিখণ্ডন করা। এই একটি বাক্য দিয়েই আল্লাহ তায়ালা তাদের সকল অপযুক্তির জবাব দিয়েছেন। অতঃপর যার ইচ্ছা সে সত্য গ্রহণ করুক।

'শিরক এর উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা” শিরোনাম দিয়ে অনেকটা অন্য বিষয়ের কথা বলে ফেললাম। তবে এই ভূমিকাটুকু করা প্রয়োজন ছিলো। যেহেতু বিষয়টা অত্যন্ত সিরিয়াস, সেহেতু আমি হয়তো এই বিষয়ে কিছু লিখতাম না, কিন্তু একটি অনুরোধের ভিত্তিতে লিখছি। অনুরোধটা ছিলো যে, কুরআনের আলোকে শিরক এর সহজবোধ্য সংজ্ঞা দেয়া। তবুও সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞার পরিবর্তে একটি সংক্ষিপ্ত আর্টিকেল লিখছি দুটি কারণে। প্রথমতঃ, আমার এযাবৎকালের কুরআন অধ্যযন থেকে কোথাও আলাদাভাবে শিরক এর সংজ্ঞা পাইনি। যেখানেই উল্লেখ আছে, সরাসরি বলা হয়েছে যে, “যারা শিরক করে...” কিংবা, “আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক কোরো না...” ইত্যাদি। কিন্তু এর চেয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই। স্পষ্টতঃই বোঝা যায় যে, আরবের লোকেদের কাছে যখন এই কথাগুলো বলা হতো, শিরক এর ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা তাদের প্রয়োজন হত না। সুতরাং, শাব্দিকভাবে শিরক নিয়ে খুব বেশি আলোচনা কিছু নেই। শিরক অর্থ শরীক করা, অংশীদার করা, ইত্যাদি।
দ্বিতীয় যে কারণে সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা না দিয়ে আর্টিকেল লিখছি, তা হলো, শিরক নিয়ে অসংখ্য বিভ্রান্তি আছে এবং অসংখ্য নির্দোষ কাজকে শিরক বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এমতাবস্থায় এই ভ্রান্তির উপর কিছুটা আলোকপাত না করলে হয়তো সংজ্ঞাটি ব্যর্থ হবে।

যাহোক, ইসলামী পরিভাষায় শিরক অর্থ কাউকে আল্লাহর অংশীদার করা। ব্যস, এটুকুই সংজ্ঞা। তবে – 
“আল্লাহ” কী, সেটা না জানলে কেউ শিরক করবে কী করে ? সুতরাং, শিরক করতে হলে কিংবা শিরক থেকে দূরে থাকতে হলে – উভয়টার জন্যই আল্লাহকে জানতে হবে। আর আল্লাহ তায়ালাকে কেবলমাত্র তাঁর গুণাবলি দ্বারাই চেনা সম্ভব। সুতরাং, “শিরক” কী, তা জানতে হলে আল্লাহ তায়ালার গুণাবলী জানতে হবে। অতএব, কেউ যদি শিরক সম্পর্কে জানতে চায়, আমি তাকে আগে বলবো স্রষ্টাকে জানতে, কারণ আল্লাহ তায়ালার গুণাবলী না জেনে তো কাউকে তাঁর সাথে শরীক করা কিংবা না করা সম্ভব না। 
শুনতে একটু হাস্যকর হলেও, আমি “ট্যাবলেট” আকারে ইসলামী জ্ঞান বিতরণে / গ্রহণে বিশ্বাসী নই। অর্থাৎ, আমি কারো কাছে গেলাম, কিংবা কেউ আমার কাছে আসলো, তারপর একটি ট্যাবলেট পরিমাণ জ্ঞান নিয়ে গেলো। সেখানে তালিকা করা আছে, এই এই কাজগুলো শিরক। ব্যস, সে ঐ কাজগুলো থেকে দূরে থাকবে। কিন্তু অন্য কোনো শিরক হয়তো করে বসবে, যা আমি আদৌ জানতাম না, সুতরাং সেই “ট্যাবলেট”-এ সেটা তালিকাভুক্ত করে দিইনি। এজন্যে ইসলামের প্রায় সকল বিষয়েই আগে দেখা উচিত যে, বিশুদ্ধ মৌলিক জ্ঞান পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে কিনা। না থাকলে সেটা আগে ঠিক করা উচিত। তারপর শাখা-প্রশাখাগত বিষয় মানুষ নিজেই ঠিক করে নিতে পারবে।

একারণে আমি কোনো তালিকা করতে চাই না যে, এই এই কাজগুলো শিরক। বরং কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই, যেসকল প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে শিরক সংক্রান্ত ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটবে, এবং স্রষ্টার গুণাবলী জানতে উৎসাহ জাগবে।

তবে স্রষ্টার কয়েকটি অবশ্য-গুণাবলীর কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। যদিও প্রত্যেকটি বিষয়ই আলাদা আলোচনার দাবীদার, তবুও প্রসঙ্গক্রমে সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।
১. আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি, ধ্বংস ও সময় থেকে মুক্ত। সুতরাং, এসকল প্রশ্নের উত্তর খোঁজা তো দূরের কথা, বরং এসকল প্রশ্ন-ই অবান্তর যে : পৃথিবী সৃষ্টির আগে আল্লাহ কী করতেন ? আল্লাহর সৃষ্টি হলো কবে / কে করলো ? ইত্যাদি। বরং “সময়” বিষয়টিই আল্লাহর সৃষ্টি, ধ্বংসশীলতা-ও আল্লাহরই সৃষ্টি।
২. তিনি স্থানে সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত। সুতরাং, আল্লাহর হাত আছে, ডান হাত-বাম হাত আছে, কিংবা আল্লাহ চোখ দিয়ে দেখেন, আল্লাহ “আরশ” এর উপর বসে থাকেন যেভাবে আমরা চেয়ারে বসি, আল্লাহ আসমানে আছেন, আল্লাহর শরীর আছে, আকার আছে, ওমুক ব্যক্তির উপর আল্লাহ ভর করেছেন, আল্লাহ সব জায়গায়ই আছেন, মানুষের মাঝেও আছেন, গাছ-পালা-নদী সবকিছুর মাঝেই আছেন, কিংবা এই পৃথিবীতে আমরা আছি আর আল্লাহ আছেন আরেক “জায়গায়”, ইত্যাদি বক্তব্য-ই অবান্তর। এসব কথা আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য নয়। কেউ যদি বলে যে, আল্লাহ কোথায় থাকেন ? তাহলে সেটি একটি অবান্তর প্রশ্ন। কারণ “কোনো জায়গায় থাকা / অবস্থান করা” বিষয়টি সসীম সৃষ্টির জন্য প্রযোজ্য। আল্লাহ তায়ালা “স্থান” নামক বিষয়টিকে সৃষ্টি করেছেন, এবং সেখানে আমাদেরকে রেখেছেন। স্থানগত সীমা মহান আল্লাহ তায়ালার জন্য প্রযোজ্য নয়। সুতরাং, “আমিতো এখানে, আল্লাহ কি আকাশে / আল্লাহ কোথায় ?” এজাতীয় প্রশ্নই অবান্তর, কারণ আল্লাহর জন্য “স্থান” বিষয়টি প্রযোজ্য নয়। এক সৃষ্টির সাথে আরেক সৃষ্টির স্থানগত সম্পর্ক হতে পারে, যেমন আমি এই চেয়ারে এবং আপনি ঐ চেয়ারে বসে আছেন। কিন্তু সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার স্থানগত সম্পর্ক হতে পারে না, কারণ স্রষ্টা স্থানের উর্ধ্ব সত্ত্বা।
৩. স্থান-কালের উর্ধ্বে, সর্বোপরি সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে বলে আল্লাহ তায়ালার কোনো আকার নেই। কারণ “আকার” বিষয়টাই সীমাবদ্ধতা, আর আল্লাহ তায়ালা সকল সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে। বরং “সীমাবদ্ধতা” বিষয়টিই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তাঁর সৃষ্টির জন্য।
৪. তিনি সদা জ্ঞানী। অর্থাৎ, সকল জ্ঞান-ই আল্লাহ তায়ালার। এক্ষেত্রে অবশ্য এই প্রশ্ন আসে যে, “তাহলে আমি বেহেশতে যাবো কি দোযখে যাবো, কাউকে খুন করবো কি করবো না – সবই আল্লাহ জানেন, তার মানে আল্লাহ আগে থেকেই আমার কপালে দোযখ লিখে রেখেছেন।” এটা অনেক বড় আলোচনার বিষয়, যা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। তবে সংক্ষেপে বলতে গেলে, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, যার দ্বারা সে ভালো-মন্দ যেকোনো জিনিসকে গ্রহণ করতে পারে। তবে গোটা সৃষ্টিজগৎই আল্লাহ তায়ালার জ্ঞানের আওতাভুক্ত, এবং এর সকল জ্ঞান-ই তাঁর। প্রকৃতপক্ষে, তিনিই জ্ঞান। তবে আল্লাহ চাইলে কোনো ঘটনাকে কারো জন্য নির্ধারিত করে দিতে পারেন। সেটা কমবেশি যেকোনো ঘটনা-ই হতে পারে। কিন্তু সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবিচারও নয়, আবার এটাও নয় যে আমার গোটা জীবন-ই পুর্বনির্ধারিত।
৫. এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা সত্যবাদী, দয়ালু, কঠোর, সুবিচারকারী, প্রার্থনা কবুলকারী, শাস্তিদানকারী, ক্ষমাকারী ইত্যাদি।

আশা করি আমি কোথাও শিরকী কাজের তালিকা করিনি। তবে ভুল ধারণা খণ্ডনের জন্য কয়েকটি বিষয় বলছি।

শক্তির নিত্যতা সূত্র = শিরক ?
শক্তির নিত্যতা সূত্র অনুসারে, শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই। অথচ আমরা জানি যে, কেবলমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালা-ই সৃষ্টি ও ধ্বংসের উর্ধ্বে। তাহলে কি আল্লাহর সাথে শরীক করা হয়ে গেলো ?
আসলে এখানে একটি ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। এ পর্যন্ত বিজ্ঞানের জ্ঞান-গবেষণায় যে প্রমাণিত হয়েছে, শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই, বরং এক রূপ থেকে আরেক রূপে পরিবর্তিত হয় – এটি সত্য। আবার এ-ও সত্য যে আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই। কিন্তু আমরা যেই “শক্তির” নিত্যতা সূত্র তৈরী করেছি, যার উপর ভিত্তি করে আইনস্টাইন E=mc^2 সূত্র দিয়েছেন, সেই শক্তি হলো সসীম শক্তি। আল্লাহ তায়ালা এই শক্তিকে সৃষ্টি করেছেন। এই সসীম শক্তি তাঁর সসীম সৃষ্টিজগতের মাঝে বিচরণ করে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ একে ধ্বংস করে দেবেন। কিন্তু এর মধ্যবর্তী সময়ে সমগ্র সিস্টেমে শক্তির ধ্বংস হবে না, কেবল এক রূপ থেকে আরেক রূপে পরিবর্তন হবে। সুতরাং, এটা হলো মহান আল্লাহ তায়ালারই অসীম নৈপুণ্যের সৃষ্টির একটি নিদর্শন। একে ভুল ভাবার কোনো কারণ নেই। এবং এটাকে সত্য মানলে যে শিরক হবে, তা-ও মনে করার কারণ নেই। কারণ আল্লাহ তায়ালা “শক্তি” কে সৃষ্টি করার পর আবার যখন ধ্বংস করবেন, তার আগ পর্যন্ত কোনো নতুন শক্তির সৃষ্টি বা বর্তমান শক্তির ধ্বংস হয় না, বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত যে, বরং তার রূপ পরিবর্তন ঘটে।

আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিকর্তা। এখন, আমার বন্ধু গাছ কেটে একটা চেয়ার বানালো। আমি যদি বলি যে, আমার বন্ধু চেয়ারটি বানিয়েছে, তাহলে কি শিরক করা হবে ?
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এখন, আমি যদি সদ্যজাত একটি শিশুকে দেখিয়ে বলি যে, এই লোক এবং এই মহিলা শারীরিক সম্পর্কের দ্বারা এই শিশুর জন্মদান করেছে, তবে কি শিরক হবে ?
আল্লাহ তায়ালা সাহায্যকারী, উদ্ধারকারী। এখন, রাস্তায় সন্ত্রাসীদের কবল থেকে এক লোক আমাকে উদ্ধার করলো। আমি বাসায় এসে বলছি : ওমুক লোকটি আমাকে উদ্ধার করেছে। এটা কি শিরক হলো ?
আমরা আল্লাহরই ইবাদত করি, এবং তাঁরই কাছে প্রার্থনা করি। এখন, আমি আমার বন্ধুর কাছে কিছু টাকা ধার চাইলাম। আমি কি শিরক করলাম ?
আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন যে তিনিই বৃষ্টি প্রদান করে ফসল উৎপন্ন করেন। এখন, এক কৃষক জমিতে ধান লাগিয়েছে এবং তাতে ফসল ফলেছে। আমি যদি বলি, এই কৃষক এই ফসল উৎপাদন করেছে, তবে কি তা শিরক হবে ?
আল্লাহই সাহায্যকারী। সুতরাং, “ভাই, আমাকে একটু সাহায্য করো তো, কী করলে ব্যবসায় উন্নতি করতে পারবো ?” একথা বলা কি শিরক হবে ?

আসলে, মৌলিক বিষয়ে জানা না থাকলে মানুষ এসব কাজকে শিরক বলে থাকে। অথচ এগুলোর একটিও শিরক নয়। স্রষ্টার গুণাবলী না জেনে শিরক নিয়ে আলোচনা করা অবান্তর। তাই শিরকী কাজের তালিকা করার আগে স্রষ্টার গুণাবলী নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। আর যখন কোনো ব্যক্তি স্রষ্টার গুণাবলী যথাযথভাবে জানবে, তখন তার আর শিরকের তালিকার প্রয়োজন হবে না, কিংবা কোনো মানুষের কাছে হেল্প চাওয়াটাকেও শিরক মনে করবে না।

হয়তো আরো অনেকগুলো বিষয়ের উল্লেখ করতে পারতাম যে কোনগুলোকে লোকে শিরকী কাজ বলে অথচ আসলে শিরক নয়, এবং কোন কাজগুলো আসলেই শিরক, কিন্তু সেই তালিকা করা থেকে বিরত থাকলাম। এই উদ্দেশ্যে যে, এমন একটি তালিকা কারো হাতে তুলে দেয়ার অর্থ হলো পক্ষান্তরে তাকে স্রষ্টার গুণাবলী নিয়ে জ্ঞান গবেষণা করতে নিরুৎসাহিত করা। সুতরাং, যখন এমন একটি প্রশ্নের উত্তর দেবার সুযোগ পেয়েছি যে, যে প্রশ্নের উত্তর হিসেবে মানুষকে আল্লাহর গুণাবলীর চিন্তায় নিয়োজিত করতে পারবো, তখন সেই সুযোগকে “ট্যাবলেট” ইসলামী জ্ঞানের বিনিময়ে হারানো উচিত হবে না। তাই শিরকের বিস্তারিত সংজ্ঞাও লিখলাম না, কোনগুলো শিরকী কাজ আর কোনগুলো নয়, তার তালিকাও করলাম না। বরং যে ব্যক্তি শিরক থেকে বাঁচতে চায় কিংবা শিরকী কাজ কী কী তা জানতে চায়, সে আগে স্রষ্টার গুণাবলী নিয়ে আলোচনা করুক, চিন্তা করুক। এরপর সে আর কোথাও শিরকী কাজের তালিকা খুঁজবে না, আমি নিশ্চিত। আর আল্লাহ তায়ালাকে জানার জন্য বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের আশ্রয়-ই যথেষ্ট।

আগ্রহীদের জন্য : যারা কুরআনে শিরক সংক্রান্ত রেফারেন্স চান, এখানে দেখতে পারেন :
(সূরা আন নিসা, ৪:১১৬), (সূরা আনআম, ৬:১৪৮), (সূরা ইউসুফ, ১২:১০৬), (সূরা ইব্রাহীম, ১৪:২২), (সূরা আন-নূর, ২৪:৫৫), (সূরা আনকাবুত, ২৯:৮), (সূরা লোকমান, ৩১:১৫), (সূরা জ্বীন, ৭২:১-৩) এবং :

সূরা ১১২ – ইখলাস

(1) Say : He is Allah, the One and Only;
(2) Allah, the Eternal, Absolute (اللَّهُ الصَّمَدُ);
(3) He begetteth not, nor is He begotten;
(4) And there is none like unto Him.

(১) বলুন, তিনিই আল্লাহ, তিনি এক, একক,
(২) আল্লাহ অমুখাপেক্ষী (আল্লাহুস-সামাদ),
(৩) তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাঁকে জন্ম দেয়নি,
(৪) এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।

নূরে আলম
ডিসেম্বর ৬, ২০১৩।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

টাকার ইতিহাস, মানি মেকানিজম ও ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মহা জুলুম

ভূমিকা: জালিমের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম  (মহররম: ইনফো সিরিজ এর শেষ পোস্ট ছিল এটা। মূল সিরিজটি পড়ে আসুন ) জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাস হলো মহররম মাস। জালিমের মুখোশ উন্মোচনের মাস মহররম। জুলুমের কূটকৌশল উন্মোচনের মাস মহররম। আধুনিক সেকুলার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় লেজিসলেশান (সংসদ), আর্মড ফোর্সেস (আর্মি) ও জুডিশিয়ারি (আদালত) হলো এক মহা জুলুমের ছদ্মবেশী তিন যন্ত্র, যারা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে জুলুম টিকিয়ে রাখার জন্য। তারচেয়েও বড় জালিম হলো big corporations: বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, যারা তাবৎ দুনিয়াকে দাস বানিয়ে রেখেছে। আর এই দাসত্বের শৃঙ্খলে তারা আমাদেরকে আবদ্ধ করেছে ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মাধ্যমে: টাকা আমাদের শ্রমকে ধারণ করে, অথচ সেই টাকার মূল্য আপ-ডাউন করায় অন্যরা -- ব্যাংক ব্যবসায়ীরা! টাকা আমাদের শ্রমকে সঞ্চয় করার মাধ্যম, অথচ সেই টাকা আমরা প্রিন্ট করি না, প্রিন্ট করে (ব্যাংকের আড়ালে) কিছু ব্যবসায়ী! সেই টাকার মান কমে যাওয়া (বা বেড়ে যাওয়া) আমরা নির্ধারণ করি না -- নির্ধারণ করে ব্যাঙ্ক (ব্যবসায়ীরা)! ইমাম হুসাইনের (আ.) প্রতিবাদী চেতনাকে ধারণ করব, শোকাহত হ

ধর্মব্যবসা: মুসলমানদের হাতে ইসলাম ধ্বংসের অতীত-বর্তমান (১)

ভূমিকা যদিও পলিটিকাল-রিলিজিয়াস ইস্যুতে নিশ্ছিদ্র আর্গুমেন্ট উপস্থাপন করে আলোচনা করার অভ্যাস আমার, কিন্তু এখানে বিস্তারিত ইতিহাস তুলে ধরে আর্গুমেন্ট করার প্রথমতঃ ইচ্ছা নেই, দ্বিতীয়তঃ সময় ও সুযোগ নেই। আমি যা সত্য বলে জানি, তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি। যারা আমার উপর আস্থা রাখেন তাদের জন্য এই লেখাটি সোর্স অব ইনফরমেশান, উন্মুক্ত হৃদয়ের মানুষদের জন্য সত্য অনুসন্ধানের নতুন কিছু টপিক, আর প্রেজুডিসড ধর্মান্ধ রোগগ্রস্ত অন্তরের জন্য রোগ বৃদ্ধির উছিলা। শেষ পর্যন্ত আর্গুমেন্ট ও ডায়লগের দুয়ার উন্মুক্ত রাখার পক্ষপাতী আমি, কিন্তু সেই আর্গুমেন্ট অবশ্যই সত্য উন্মোচনের নিয়তে হওয়া উচিত, নিজের দীর্ঘদিনের লালিত বিশ্বাস ও ধ্যান ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করবার উদ্দেশ্যে নয়। মক্কা-মদীনা: মুহাম্মদ (সা.) থেকে আলে-সৌদ (৬২৯-১৯২৪) এদেশের অধিকাংশ মানুষ মক্কা-মদীনার ইতিহাস কেবল এতটুকু জানেন যে, মুহাম্মদ (সা.) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন। কিন্তু প্রায় চৌদ্দশ’ বছর আগে মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র থেকে আজকের রাজতান্ত্রিক সৌদি আরবের ইতিহাস কম মানুষই জানেন। প

পিস টিভি, জাকির নায়েক ও এজিদ প্রসঙ্গ

সম্প্রতি গুলশান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। আমি তখন দিল্লীতে ছিলাম। দেশে ফিরে শুনি পিস টিভি ব্যান করা হয়েছে বাংলাদেশে, এবং তার আগে ইন্ডিয়াতে। আমার বাসায় টিভি নেই, এবং আমি জাকির নায়েকের লেকচার শুনিও না। কিংবা পিস টিভিতে যারা লেকচার দেন, বাংলা কিংবা ইংলিশ -- কোনোটাই শুনি না; প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া আমার ইসলামের বুঝ জাকির নায়েকসহ পিস টিভি ও তার বক্তাদেরকে ইন জেনারেল আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। Peace TV বন্ধ হওয়ায় এদেশে বিকৃত ইসলাম প্রসারের গতি কমলো -- এটাই আমার মনে হয়েছে। একইসাথে আমি এটাও মনে করি যে, যেই অভিযোগ পিস টিভিকে ব্যান করা হয়েছে, তা নিছক অজুহাত। জাকির নায়েক কখনো জঙ্গীবাদকে উস্কে দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। কিংবা পিস টিভির লেকচার শুনে শুনে ISIS জঙ্গীরা সন্ত্রাসী হয়েছে -- এটা নিতান্তই হাস্যকর কথা। ISIS এর ধর্মতাত্ত্বিক বেইজ সম্পর্কে মোটেও ধারণা নেই, এমন লোকের পক্ষেই কেবল ISIS এর জন্য জাকির নায়েককে দোষ দেয়া সম্ভব। একইসাথে আমি এ বিষয়েও সচেতন যে, পিস টিভি বন্ধ করা হয়েছে আমাদের সরকারের রেগুলার “ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের অংশ